রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

কাঙাল হরিনাথ ~ নবশ্রী চক্রবর্তী বিশ্বাস

গ্রীষ্মের অপরাহ্ন। গ্রামের কচিকাচার দল বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে গৃহে ফিরছিল। পথ প্রায় জনশূন্য ছিল এতক্ষণ। এখন শিশুদের কলকাকলিতে পথ-ঘাট-পুকুরের যেনো তন্দ্রাভঙ্গ হল। শিশুদিগের মুখে এক অপূর্ব আহ্লাদ! গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহও সেই উত্তেজনায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাদের গ্রীষ্ম-অবকাশের সূচনা হয়েছে যে! সেই আনন্দই তাদের চোখেমুখে প্রতীয়মান। পথপার্শ্বে চণ্ডীমণ্ডপের দক্ষিণের একটি কক্ষ থেকে কোলাহলের শব্দ শুনে কিছু শিশু থমকে দাঁড়ালো, বাকি শিশুরা নিজ নিজ বাড়ীর পথ ধরলো। 

      দুটি শিশু কোলাহলের শব্দ অনুসরণ করে খুব ধীরে পদসঞ্চারণ করে কক্ষের গবাক্ষের সমীপে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। তন্মধ্যে একজন শিশু কৌতুহলবশতঃ উকিঝুঁকি দিতে উদ্যত হ'লে কক্ষের অন্দর থেকে এক যুবক কণ্ঠ ভেসে এলো। যুবকটি দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলো, "একটা বাউলগানের দল করলে কেমন হয়! তোমরা কি বলো!" কথাটা শেষ হতেই ঘরে এক নিস্তব্ধতার পরিবেশ সৃষ্টি হল। আরেক যুবক উত্তর দিলো, "কথাটা মন্দ বলোনি অক্ষয়। এইতো প্রাতঃকালে কালিগঙ্গা থেকে এক বাউল এসেছিলেন। শুনেছি তাঁর অনেক শিষ্য। কি যেন নাম!" পাশ থেকে আরেক যুবক উত্তর করলেন, "লালন ফকির! কি ভারী সুন্দর একখানি গান শোনালে গো!" যুবকটি সম্মতি জানিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, "তিনি পারলে, আমরাও পারবো।" অক্ষয় বললো, "ঠিক! আজই, এখন থেকেই আমরা বাউল দল তৈরী করবো।" অপেক্ষাকৃত এক বয়স্ক ব্যক্তি বললে, "কাজটি সহজ নয় অক্ষয়। নতুন গান বাঁধতে হবে যে!" অক্ষয় বললো, "হলে হবে, আমরা ভয় করবো না। একটা কলম আর কাগজ নিয়ে আয় জলদা! আর যা যা বলছি, কাগজে লিখেনে।" জলদা নামের যুবকটি বাধ্য ছেলের মত একটা কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলো। অক্ষয় বলতে শুরু করলো -
  
"ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশি,
                  সত্য- পথের সেই ভাবনা।
যে পথে চোর ডাকাতে, কোন মতে,
                  ছোঁবে না রে সোনা দানা । ....... "

    গানটির অনেক কলি লেখা হ'লে, অক্ষয় থামলো। মধ্যবয়সী পুরুষটি বললেন, "এতে তো হবেনা। বাউল গানের নিয়ম হলো গানের শেষে ভণিতা দিতে হবে।" তার সামনে বসা যুবকটি বললো, "আপনি পণ্ডিত মানুষ, আমাদের এইটুকু ত্রুটি নয় মার্জনা করলেন!" অক্ষয় বললো, "না লিখছি যখন, নিয়ম মেনেই লিখবো।" উত্তেজিত হয়ে জলদা বললো, "এতো চিন্তার কি আছে ভাই! চল না কাঙালের কাছে যাই। তিনিই সুন্দর ভনিতা লিখে দেবেন।" অক্ষয় বলল, "না জলদা, আমিই ভণিতা লিখবো। তাঁকে আমি অবাক করে দিতে চাই।" জলদা আবার কলম ধরল, অক্ষয় বলতে লাগলো -
    
     "ফিকিরচাঁদ ফকির কয় তাই, কি কর ভাই,
                                          মিছামিছি পর ভাবনা ।
        চল যাই সত্য পথে, কোন মতে,
                                           এ যাতনা আর রবে না।"
     
    গানের ভণিতা সমাপ্ত হলো। সকলে সমস্বরে বললো, ঠিক, এই ফিকিরচাঁদ নামটাই সঠিক। জলদা বললো, "আমাদের তো ধম্ম ভাব নেই এক চিলতে। ফিকিরে সময় কাটাবো, এটাই মুখ্য উদ্দেশ্য।" 

      গানের সুর দিলেন আরেক যুবক। সুর শেষ হতেই জলদা বললো, "চল হে, একবার কাঙালকে শুনিয়ে আসি।" এই বলে যুবকগুলি দল বেঁধে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে অনতিদূরে পার্শ্ববর্তী এক ছোট কুটিরের উদ্দেশ্যে চললো। শিশুগুলি নিঃশব্দে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। তারা এখন যুবকদলটিকে অনুসরণ করতে লাগলো। তারা ভাবলো, এবার বুঝি খুব আমোদ হবে। উত্তেজনায় যুবকদলের কেউ শিশুগুলিকে খেয়াল করলো না। যুবকদল সেই ছোট কুটিরে প্রবেশ করলো। কুটিরের একটি কক্ষে এক মধ্যবয়সী মানুষ, একটি কাষ্ঠনির্মিত ভগ্ন আরামকেদারায় বসে কি যেন লিখছেন। তার গাত্রে ছিন্ন- পরিচ্ছন্ন -শুভ্রবস্ত্র, কেশ রুক্ষ, চোখ দুখানি আয়ত - উজ্জ্বল, মুখখানি জীবনযুদ্ধে কিছুটা ম্লান হলেও, জীবনীশক্তিতে ভরপুর। যুবকের দল একে একে এসে নিঃশব্দে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। তাঁর ছোট কুটিরের কক্ষে আর স্থান সংকুলান হয়না! এদিকে মানুষটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি লিখেই চলেছেন আপনমনে। হঠাৎ যুবকদলের মধ্যে কারো কারো ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। তাদের মধ্যে মৃদুস্বরে বাক্যালাপ শুরু হ'লে, সেই শব্দেই মানুষটি লেখা ছেড়ে যুবকদলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তাদের দেখে তিনি যারপরনাই তৃপ্তি পেলেন। সেই তৃপ্তি তাঁর ব্যবহারে ও কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেল । তিনি যুবকদের সোৎসাহে বললেন, "আরে তোরা! কি ব্যাপার! কোনো সংবাদ আছে নাকি! একেবারে দল বেঁধে!" জলদা বললো, "আছেই তো ! তাই তো এলাম। আমরা বাউলগান লিখেছি। সুর করেছি। আপনাকে শোনাতে এলাম। আপনি যদি রাজী হন, তো কাল থেকেই আমরা এই গান গেয়ে গ্রামের পথে পথে ঘুরবো।" মানুষটি হাতের কাগজটা রেখে এসে বললো, "শোনা দেখি!" তাঁর উৎসাহ দেখে যুবকদল ততোধিক উৎসাহে গান ধরলো। গান গাইতে গাইতে তারা নাচতে লাগলো। মানুষটিও তাদের সাথে যোগ দিলো। মনে হলো, কিছু বাউল মনের আনন্দে গান গাইছে আর নাচছে। শিশুর দল বড়ই আমোদ অনুভব করলো। নাচ-গান সমাপ্ত হলে শিশুর দল স্ব স্ব বাড়ীর উদ্দেশ্যে ধাবিত হল। পথে যাদের সাথেই দেখা হলো, তাদেরই বললো, "কাল এখান দিয়ে বাউল গানের দল যাবে গো।" সকলেই উৎসাহিত!

     এদিকে কক্ষ মধ্যে শোরগোল পরে গেল। যুবকের দল উত্তেজনায় ফুটতে লাগল। কাঙাল বললেন, "দ্যাখ, একটা গানে তো আর বাউলের দল হয় না। তাই ভাবছি আমিও একটা লিখবো। অক্ষয় কলম ধর!" তিনি বলতে লাগলেন -
  
    "আমি কোরব এ রাখালী কতকাল ।
      পালের ছটা গরু ছুটে,
                         করছে আমার হাল বেহাল ।
     আমি, গাদা করে নাদা পুরে রে,
    কত যত্ন ক'রে খোল বিচালী খেতে দিই ঘরে ;.....,"

     এই দুটি গান সম্বল করে পরের দিন যুবকদল সন্ধ্যাকালে বাউলের পোশাকে ও সজ্জায় সুসজ্জিত হয়ে খোল করতাল নিয়ে গ্রামের পথে বেরোলো। তাদের নগ্নপদ, গেরুয়া বসন, কারো মুখে কৃত্রিম দাড়ি, কিন্তু মুখে সকলের অনাবিল হাসি। গ্রামের মেঠো পথ ধরে "ফিকিরচাঁদ ফকিরের" দল গান গাইতে গাইতে চললো। বাউলের দলের সম্মুখে চললেন কাঙাল। তাঁকে অনুসরণ করলেন তাঁর স্নেহধন্য যুবকরা। পথের দুই ধারে মানুষের ঢল নামলো। এইভাবে একদিন-দুইদিন-তিনদিন করে প্রায় প্রতিদিনই বাউলের দল বের হয়ে গ্রামের পথে পথে গান গেয়ে বেড়ায়। ধীরে ধীরে গানের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, সেই সাথে গানের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে ফিরতে শুরু করলো এইসব গান। এই ছোটো পরিসরে রইলো সেই ফিকিরচাঁদ ফকির দলের প্রধান কান্ডারী কাঙালের সংক্ষিপ্ত জীবনী। 
       
     ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির অন্তর্গত কুন্ডুপাড়া গ্রামে এক তিলি পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার৷ যিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন 'কাঙাল হরিনাথ' নামে৷ তাঁর পিতার নাম হরচন্দ্র (মতান্তরে হলধর) মজুমদার ও মাতার নাম কমলিনী দেবী। 
 
       বাল্যকালেই তাঁর পিতৃমাতৃ বিয়োগ ঘটে। শৈশবে
কিছুকাল কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজী বিদ্যালয়ে বিদ্যালাভের সুযোগ ঘটেছিল তাঁর৷ কিন্তু নিদারুণ অর্থকষ্টে তিনি তাঁর বিদ্যাচর্চা সমাপ্ত করতে পারেননি। তিনি তাঁর জীবনীতে লিখেছিলেন, পিতাকে দাহ করে ফিরে পরনের বস্ত্রটুকু পরিবর্তনের মত বস্ত্র ও ভক্ষণের নিমিত্ত সামান্য হবিষান্নটুকুও তাঁর গৃহে ছিল না। শৈশবকালে পিতৃবিয়োগের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পড়াশোনা শেষ না করতে পারার যন্ত্রণা তিনি আজীবন বয়ে বেরিয়েছেন!
এই সময় ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য্যদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কুমারখালি প্রদেশে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের জন্য পণ্ডিত দয়ালচাঁদ শিরোমণি মহাশয়কে প্রেরণ করেছিলেন। হরিনাথ, শিরোমণি মহাশয়ের নিকট কিছু ব্যাকরণ পাঠ করতে লাগলেন এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও তৎকালে প্রকাশিত ব্রাহ্মধর্মে কিছু গ্রন্থ অধ্যয়ণ করেছিলেন।

       শৈশবের সেই দুর্বিষহ অভাবই তাঁর জীবনে পরমপাথেয় হয়ে দাড়িয়েছিল৷ ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি  গ্রামে একটি মাতৃভাষার বিদ্যালয় (ভার্নাকুলার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাপারে তিনি পাশে পেয়েছিলেন গোপাল কুণ্ডু, যাদব কুণ্ডু, গোপাল সান্যাল প্রমুখ বন্ধুদের৷ সেই বিদ্যালয়ে তিনি কিছুদিন অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে ইংরেজী শিক্ষার পদ্ধতি অনুসরণ করে গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় সাহিত্য, ব্যাকরণ, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তাঁর মাসিক বেতন হয় কুড়ি টাকা। কিন্তু এর থেকে পনের টাকা গ্রহণ করে বাকী অর্থটুকু তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। 

       নারী শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন সময়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে নারীদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। যে ক'জন উদারমনস্ক ও সাহসী ব্যাক্তিত্ব এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কাঙাল হরিনাথ। অর্থ ব্যতীত আর অন্য কোন বিষয়ে অপ্রতুলতা বিধাতা তাঁর মধ্যে দেননি। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কাঙাল হরিনাথের সহায়তায় কৃষ্ণনাথ মজুমদার একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন কুমারখালিতে।
 
     তাঁর যে সকল বিষয় অধীত ছিল না, তা গৃহে তাঁর বাল্যবন্ধু মথুরামোহন মৈত্র (সাহিত্য ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রের পিতা) মহাশয়ের নিকট শিক্ষা ও অভ্যাস ক'রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করতে লাগলেন। যারা বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে অসামাজিক কাজকর্মে নিযুক্ত হয়ে পড়েছিল, সেই সমস্ত ছাত্রদের নিয়ে তিনি নৈশ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করেন। এই নৈশ বিদ্যালয়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল।

    তিনি আজীবন দুর্বিষহ দারিদ্রের সাথে লড়াই করেছেন। অর্থ উপার্জনের জন্য কুমারখালিতে তিনি কিছুদিন নীলকর সাহেবদের অধীনে চাকরী করেন। কিন্তু নীলকর সাহেবদের নীল কৃষকদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার সন্দর্শণে তিনি এই চাকরি পরিত্যাগ করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তাঁর বাল্যবন্ধু মথুরানাথ হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাতে লেখা শুরু করেন। তাই দেখে হরিনাথও হাতে কলম তুলে নেন। কাঙাল হরিনাথ তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, "সাধ্য ততদূর না থাকুক, প্রজার প্রতি নীলকরদের অত্যাচার যাতে নিবারিত হয়়, তার উপায় চিন্তাকরণ আমার ও মথুরের নিত্যব্রত ছিল।" তার তথ্য-ঋদ্ধ লেখনীতে মূর্ত হয়ে উঠত কৃষকদের অসহায় পরিস্থিতি ও নির্যাতিত-লাঞ্ছনা -বঞ্চনা-যন্ত্রণাময় জীবন। প্রথমদিকে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাতে লেখালেখি শুরু করেন। তারপর ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কুমারখালিতে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর আত্মজীবন চরিতে লিখেছেন, "ঘরে নেই এক কড়া, তবু নাচে নায় পাড়া। আমার ইচ্ছা হলো এইসময় একখানি সংবাদপত্র প্রচার করে গ্রামবাসী প্রজারা যেরূপে অত্যাচারিত হচ্ছে, তা গভর্নমেন্টের কর্ণগোচর করলে অবশ্যই তার প্রতিকার এবং তাদের নানা প্রকার উপকার সাধিত হবে। সেই ইচ্ছাতেই গ্রাম ও পল্লীবাসী প্রজার অবস্থা প্রকাশ করব বলে পত্রিকার নাম গ্রামবার্তা প্রকাশিকা রেখেছি।"

এর পাশাপাশি কবি ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাতে তিনি  প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। তাঁর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন  এর যন্ত্রে মুদ্রিত হত, কিন্তু প্রকাশিত হতো কুমারখালী থেকে (বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার ইতিহাসের উপাদান -কাঙাল কুঠির ও এম এন প্রেস)।

  সংবাদপত্রের আদিযুগে একজন দরিদ্র অসহায় দীনহীন কাঙ্গাল, অতুলপ্রতিভা ও ঐশীশক্তিবলে দেশের জন্য এইরূপ বহুব্যয় সংবাদপত্রের প্রচারে ব্রতী হলেন। বিশেষত তখন নিজের বা মফস্বলের কোথাও মুদ্রাযন্ত্র ছিল না। কলকাতায় যাতায়াতের সুবিধা ছিল না, কারণ পূর্ববঙ্গের রেলপথ তখনো খোলা হয়নি। এই সময়ে কলকাতায় সংবাদপত্র মুদ্রিত করে প্রকাশ করা অসম্ভব সাহসের পরিচয়। তখন সাধারণ মানুষের সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস গঠিত হয় নি। সংবাদপত্রের মূল্য অত্যধিক থাকায় ধনী ভিন্ন সাধারণের তা গ্রহণ করার সামর্থ ছিলনা। সেই কারণে সংবাদপত্রের কথা সাধারণ মানুষ পরীজ্ঞাত ছিল না। কাঙাল হরিনাথ ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে এই দুরূহ কাজে হস্তক্ষেপ করিলেন। এই দুরূহ কার্য সম্পন্ন করার জন্য তিনি নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পরিত্যাগ করেন। বিদ্যালয়ের প্রাপ্য বেতন তার সংসারযাত্রা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিল। পত্রিকায়  সেই উপায় হয় না, যার দ্বারা তিনি সংসারকার্য নির্বাহ করতে পারেন। সুতরাং অতিকষ্টে সংসারের ব্যয় নির্বাহ হতে লাগলো। তিনিই নিজেই ছিলেন একাধারে লেখক, সম্পাদক, পত্রিকা বিলিকারক এবং মূল্য আদায়কারী অর্থ সংগ্রাহক। তাঁর জীবনযন্ত্রণা তিনি লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে, "এই দিন চৈত্রমাসের দুপ্রহরের রৌদ্রের সময় পদ্মার  তীরস্থ তাপিত বালুকাময়ী চড়া অতিক্রম করতে পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ ও রৌদ্রতাপে তাপিত হয়ে যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছিলাম, যদি গ্রামবার্তার প্রতি প্রেমানুরাগ সঞ্চিত না থাকতো, তবে তা তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগের কারণ হত।"

     ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কুমারখালিতে তিনি নিজস্ব পত্রিকা ছাপানোর জন্য ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮ বছর ধরে রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারী দেবী এই ছাপাখানার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেন। হরিনাথ তাঁর গ্রামের মানুষদের অসহায়তা, দারিদ্র্য প্রতিকারের চিন্তা থেকেই এই কার্যে ব্রতী হন ('কাঙাল হরিনাথ ও ' গ্রামবার্তা প্রকাশিকা', কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ - আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৮)।

কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা

      গ্রামবার্তা দ্বারা এ দেশের প্রভূত উপকার সাধিত হয়। এটা যে শুধুমাত্র জমিদারের মহাজনের এবং নীলকুঠির অত্যাচার নিবারণ সাধন করেছিল তাই নয়, প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য সম্পর্কে যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো, তদনুসারে কার্য করতে ইংরাজ সরকারেরও যথেষ্ট প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সংবাদপত্রের অনুবাদক মিঃ রবিনসন সাহেব স্বয়ং "গ্রামবার্তা" গ্রহণ করেছিলেন এবং সরকারের গোচরার্থে গ্রামবার্তা থেকে যে অনুবাদ হত, তাতে গ্রামবাসীর বিশেষ উপকার হয়েছিল। এতে করে গ্রামের নদী খাল প্রভৃতি পয়ঃপ্রণালী সংস্কারপূর্বক জলকষ্ট নিবারণ, গো-ধন রক্ষা, পুলিশ বিভাগের সংস্কার ব্যবস্থা ইত্যাদি। তৎকালে "সোমপ্রকাশ"ও "গ্রামবার্তা" ই উচ্চশ্রেণীর সাময়িক পত্র ছিল।

   কাঙাল হরিনাথ যখন বাংলা সাহিত্যের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস গ্রন্থের অভাব ছিল। তখন বাহারদানেশ, চাহারদরবেশ, বিদ্যাসুন্দর, কামিনীকুমার ইত্যাদি গ্রন্থই উপন্যাসের স্থান গ্রহণ করেছিল। উপন্যাস সৃষ্টির আদিযুগে হরিনাথ "বিজয়বসন্ত" (রচনাকাল- ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দ) নামক এক উপন্যাস রচনা করে বাংলার সাহিত্যজগৎকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি ইংরেজী ভাষা জানতেন না। এদিকে তৎকালীন ইংরেজীশিক্ষায় শিক্ষিত যুবকশ্রেণী বাংলার তৎকালীন  উপন্যাসসমগ্রকে উচ্চ আসনে স্থান দিতেন না। কিন্তু হরিনাথের "বিজয়বসন্ত" মৌলিকতা, মধুরতা, এবং প্রকৃত কাব্যগুনে মাতৃভাষার যথেষ্ট গৌরব বৃদ্ধি করে বহুজনের সমাদর লাভ করে।

তাঁর স্মৃতিতে নির্মিত সংগ্রহশালা
     
       তিনি আরো অনেক গ্রন্থ রচনায় বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ৷ তার মধ্যে চারুচরিত্র (১৮৬৩), কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬), কবিকল্প (১৮৭০), অক্রুর সংবাদ, চিত্তচপলা (১৮৭৬), ব্রহ্মান্ডবেদ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷

   তাঁর প্রতিভা সর্বতোমুখী ছিল৷ তিনি ছিলেন স্বভাব কবি৷ সেই সময় কুমারখালিতে কীর্তনের বড় ধুম ছিল। অনেকেই সুললিত পদ রচনা করে বিগ্রহের পর্ব উপলক্ষে গান করতেন। হরিনাথের পদগুলি মহাজন বিরচিত পদাবলী অপেক্ষা কোন অংশে নিকৃষ্ট ছিল না। তাঁর রচিত পদ তিনি নিজেই স্বকন্ঠে গেয়ে সমবেত শ্রোতৃমন্ডলীকে মুগ্ধ করে রাখতেন। এইরূপে তিনি পূর্ববঙ্গের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার নিকটে তার বাউল সংগীতের দ্বারাই অসামান্য লোক বলে পরিচিত হয়েছিলেন। এই বাউল সংগীতের সহজ সরল প্রাণস্পর্শী কথা ও সুরে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বশ্রেণীর মানুষ উদ্বেলিত হতেন। অল্পদিনের মধ্যেই বাউলসংগীতের মধুর সুর হাটে- ঘাটে- মাঠে- নৌপথে সর্বত্রই শ্রুত হতে লাগলো -

 "হরি দিন গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে।
 তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্তা ডাকি হে তোমারে।।"
 

      তিনি সাধক লালন ফকিরের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে একটি বাউল সংগীতের দল গঠন করেন। দলটি "কাঙাল ফকিরচাঁদের দল" বলে পরিচিত। তাঁর শিষ্যগণের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন প্রমুখ বাংলার বিশেষ ব্যক্তিত্বরা। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই মহাপ্রাণের জীবনাবসান ঘটে। তিনি আমৃত্যু বঙ্গদেশের শিক্ষার প্রসার ও সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। বাঙালির অত্যন্ত কাছের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আজ তিনি প্রায় প্রচারের আড়ালে। বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সংবাদিকতা ও মননে যে সুগভীর ছাপ তিনি রেখে গেছেন তা অনস্বীকার্য।

তথ্যসূত্র :
(১) কাঙাল হরিনাথ - শ্রী জলধর সেন।
(২) কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জীবন সাহিত্য ও সমকাল - ডঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়।
(৩) কাঙাল হরিনাথ ( গ্রামীণ মনীষার প্রতিকৃতি) - আবুল আহসান চৌধুরী।
(৪)বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার ইতিহাসের উপাদান -কাঙাল কুঠির ও এম এন প্রেস।
(কলকাতা কথকথা পত্রিকায় প্রকাশিত)

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

মোটা মাথার বোকা প্রশ্ন ~ নীলাঞ্জন মিশ্র

আমি অর্থনীতিবিদ নই। অর্থনীতির কিছু বুঝিও না। আর বুঝি না বলেই বোকা মাথায় কিছু সোজাসাপ্টা প্রশ্ন আসে। সেইসব প্রশ্নদের এক জায়গায় করার জন্যই এই লেখা।
আজকের লেখার বিষয় ব্যাংক কর্মী। ব্যাঙ্কে যখন প্রথম কম্পিউটার এল তখন বলা হয়েছিল যে এর ফলে দশজন লোকের কাজ একটা মেশিন করবে। ফলে, কর্মীদের ওপর কাজের চাপ কমবে। ভাল কথা। কিন্তু আদতে সেটা হল কি? ব্যংকিং সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের ওপর কাজের চাপ কমল কি?
আজকের দিনে যে কোনও ব্যাংক কর্মীকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন। বেসরকারি ব্যাংকের কথা তো ছেড়েই দিন, এমনকি সরকারি ব্যাংকেও আর দশটা পাঁচটার কাজ করলে এখন চলে না। সব জায়গাতেই দিনে আট ঘন্টার অনেক বেশি কাজ করতে হয়।
কিন্তু কেন? কম্পিউটার এসে না কাজের চাপ কমানোর কথা ছিল? তাহলে?
আসলে কম্পিউটার কাজের চাপ কমায় নি, কমিয়েছে কর্মীর সংখ্যা। আর সাথে সাথে বাড়িয়েছে একজন মানুষ কতটা কাজ করবেন সেই প্রত্যাশা। আগে যদি একজন কর্মী গড়ে দিনে দশজন গ্রাহককে সামলাতেন, এখন তাঁকে সামলাতে হয় একশজনকে।
আপনি বলবেন, সে তো হবেই। গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছে, কাজের চাপ তো বাড়বেই। সেই জন্যই তো কম্পিউটার আনা।
আমার মোটা মাথা বলে, কর্মীর সংখ্যা না কমালে, কম্পিউটারের সাহায্যে সহজেই এই বাড়তি গ্রাহকদের চাপ সামলানো যেত। তাতে কর্মীদের ওপর কাজের চাপও এইভাবে বাড়ত না।
অর্থনীতিবিদরা বলবেন, কর্মীসংকোচন না করলে ব্যাংক চলবে কি করে? কি করে কম্পিটিশনে টিঁকে থাকবে? সেইজন্যই তো আর্থিক সমস্যায় পড়লেই যে কোনও সংস্থার প্রথম পদক্ষেপই হয় কর্মী ছাঁটাই। সহজেই যেন কেমন করে কালকের দক্ষ কর্মীরা আজ বাড়তি হয়ে যান। যাকে সংবাদপত্রের সুন্দর ভাষায় বলে, "বাড়তি মেদ ঝরিয়ে নতুন উড়ানের জন্য তৈরী এক্স ওয়াই জেড সংস্থা।"
আচ্ছা, তর্কের খাতিরে না হয় তাও মেনে নিলাম। আর্থিক মজবুতির জন্য এইসব "বাড়তি" কর্মীদের ছাঁটাই না করে কোনও উপায় নেই। তাহলে, এই কর্মীসংকোচের পর এখন তো ব্যাংকগুলোর লাভের মুখ দেখা উচিৎ? তা না হয়ে এখনও কেন ধুঁকে চলেছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক? কেন উত্তরোত্তর খারাপ হয়ে চলেছে তাদের আর্থিক অবস্থা?
ঠিক কতটা খারাপ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্বাস্হ্য? বেশ খারাপ। শুধু গত ত্রৈমাসিকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির মিলিত ক্ষতির পরিমাণ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। কতগুলো শূন্য যেন? এর মধ্যে ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ারই ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
কোথায় যাচ্ছে এত এত টাকা? যাচ্ছে অনাদায়ী ঋণে, যাকে বলা হয় নন-পারফর্মিং অ্যাসেট। এই মুহুর্তে আমাদের রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ চার লক্ষ কোটি টাকা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। চার লক্ষ কোটি। সংখ্যাটা কত বড়। একটু তুলনা করলে বুঝতে সুবিধে হবে। ইন্ডিয়ার স্বাস্থ্যখাতে বাজেট হল ষাট হাজার কোটি। অর্থাৎ, এই অনাদায়ী ঋণ দিয়ে ভারতের মত সাতটি দেশের স্বাস্হ্য বাজেট চালানো যায়। আরেকটা ছোট তথ্য। এই বছরের উনিশে ফেব্রুয়ারি ইটালিকে পেছনে ফেলে অনাদায়ী ঋণের অনুপাতে ভারত উঠে এসেছে বিশ্বের এক নম্বরে।
মজার কথা হল, এই অনাদায়ী ঋণের বোঝার পুরোটাই প্রায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাঁধে। প্রাইভেট ব্যাংকগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমান দশ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ চল্লিশ হাজার কোটি।
তাহলে কি দেখলাম? একদিকে বাড়ল বেকারি, বাড়ল কর্মীদের ওপর কাজের চাপ, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো সম্মুখীন হল এক বিশাল পরিমান আর্থিক ক্ষতির।
কি হল আসলে? কোন ঝণখেলাপি পিঁপড়ে খেয়ে গেল
লাভের গুড়, আমার আপনার কষ্টার্জিত টাকা?
এ লেখার শুরুতেই বলেছি, আমি অর্থনীতি বুঝি না। তাই কত টাকা কোথায় গেল বুঝতে আমার ভরসা গুগুল। কোন ঋণখেলাপি আমার কত টাকা খেয়ে গেল সেটা গুগুল করতে গিয়ে আরেকটা মজার জিনিষ পেলাম। জানলাম, রাজ্যসভায় এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রকের ছোটমন্ত্রী শিবপ্রসাদ শুক্লা গত বছর জুলাই মাসে জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ভারতবর্ষের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট ঋণখেলাপের পরিমান মার্চ ২০১৪তে আড়াই লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩১শে মার্চ ২০১৮-তে হয়ে দাঁড়িয়েছে নয় লক্ষ বাষট্টি হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ভারতের শিক্ষা বাজেটের দশগুন ও প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় তিনগুন।
মন্ত্রীমশাই আরও জানিয়েছেন, এই ঋণখেলাপি টাকার নব্বই শতাংশই গেছে বড় কর্পোরেটদের ঘরে।
তা কাদের ঘরে গেল এই টাকা? গুগল করে জানতে পারলাম, আরবিআই এই তথ্য প্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে গোপন কথাটি তো আর সবসময় গোপন থাকে না। ক্রেডিট সুইস বলে একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক পরামর্শদাতা সংস্হার দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫-র মার্চ অব্দি শুধু অনিল আম্বানিরই ঋণখেলাপের পরিমাণ সওয়া লক্ষ কোটি টাকা। আদানি, এসার ও বেদান্ত গ্রুপের প্রত্যেকের ঋণখেলাপের অংক কমবেশি এক লক্ষ কোটির ঘরে। আবার একটু হিসেবের সুবিধের জন্য জানিয়ে রাখি, ভারতবর্ষের শিক্ষাখাতে ২০১৯ সালের বাজেট হল কমবেশি নব্বই হাজার কোটি টাকা।
এ পর্যন্ত পড়ে কেউ বলতেই পারেন, আহা রে, বাছাদের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। নচেৎ কি আর এরা ধারদেনা বাকি রাখত? সে হয়ত যাচ্ছে, কিন্তু অক্সফ্যামের দেওয়া হিসেব কিন্তু অন্য কথা বলছে. এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটির দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ২০১৬ সালের উৎপাদিত সম্পদের ৫৮ শতাংশ গেছিল ভারতবর্ষের ধনীতম এক শতাংশের হাতে। ২০১৭ সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিয়াত্তর শতাংশে। অর্থাৎ, ভারতবর্ষে ২০১৭ সালে যদি ১০০ টাকার সম্পদ উৎপাদন হয়ে থাকে, তার মধ্যে তিয়াত্তর টাকাই ঢুকেছে একজনের পকেটে। আর দরিদ্রতম পঞ্চাশজন একসাথে পেয়েছে এক টাকা, গড়ে দু পয়সা।
এই যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য, তা কিন্তু শুধু ভারতের সমস্যা নয়, তা ঘটে চলেছে বিশ্বের কমবেশি সর্বত্র। কিন্তু আবারও আমার মোটা মাথায় খচখচ করতে থাকে, এভাবে কি চলতে পারে? কতদিন দাঁড়িয়ে থাকবে এরকম মাথা ভারী পা রোগা কাঠামো?
লেখাটা শুরু করেছিলাম ব্যাংক কর্মীদের দিয়ে, কিন্তু আসলে এই সমস্যাটা আমার আপনার সবার। একটু ভেবে বলুন তো, আজকের দিনে কোন পেশাটা আছে, যেখানে আট ঘন্টা কাজ করলে চলে? আমাদের আগের প্রজন্ম তাঁদের অফিসে যা সময় দিতেন, আমাদের সবাইকে কেন দিতে হচ্ছে তার থেকে অনেক অনেক বেশি? যন্ত্র এসে তো আমাদের জীবনকে আরও সহজ করে দেওয়ার কথা ছিল, তাই না? তাহলে আমরা চারপাশে সবাই ছুটছি কেন? ছুটছি, কেন না, আমাদের বোঝানো হয়েছে সারভাইভ্যাল অফ দা ফিটেস্ট। থ্রি ইডিয়টস সিনেমার ভাইরাসের মত আমাদের সর্বক্ষণ বোঝানো হচ্ছে, জীবন হচ্ছে একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এখানে আরাম করতে হবে নিক্তি মেপে, যার পারিভাষিক নাম, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যলান্স। আসলে কিন্তু সেই ভারসাম্য থাকছে না। কর্মী কমছে, মাথাপিছু কাজ বাড়ছে। আট ঘন্টার কাজ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দশ বা বারো ঘন্টায়। কখনও আরো বেশি। কিছু বলার উপায় নেই। কেন না তোমার অফিসের বাইরেই অপেক্ষা করছে দশ হাজার চাকরিপ্রার্থী, তোমার ওই একটা চেয়ারের জন্য। গত বছরের একটা খবরে দেখলাম, বাষট্টিটি পিয়নের পোস্টের জন্য ইউপিতে জমা পড়েছে তিরানব্বই হাজার অ্যাপ্লিকেশন। তার মধ্যে প্রায় চারহাজার জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
এর ফল গিয়ে দাঁড়াচ্ছে নির্মমতায়, হিংসায়। আমাদের বোঝানো সহজ হচ্ছে যে আমার এই চাকরির সংকটের জন্য দায়ী আমার পড়শি। সে আছে, তাই চাপ বাড়ছে, তাই আমি চাকরি পাচ্ছি না। হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে রাগ। মাথার ওপর বসে থাকা লোকেরা এই রাগটার খবর রাখেন না, এমন নয়। তারা জানেন, ওই নীচের তলার দুপয়সা ওয়ালা পঞ্চাশজন যদি একজোট হয়, তাহলে ওই তিয়াত্তরটাকা ওয়ালা একজনের সমূহ বিপদ। তাই ক্রমাগত বিভিন্ন ইস্যুতে ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে- ধর্মে ধর্মে, ভাষায়-ভাষায়, গায়ের রঙ-এ, আর নাগরিকে নাগরিকে। বোঝানো হচ্ছে, যত সমস্যার মূলে ওই মেক্সিকানরা, অতএব দেয়াল তোলো।
আমরা ভুলে যাচ্ছি, আসলে আমাদের কি প্রাপ্য ছিল। সাতমহলা বাড়ির ব্যালকনি থেকে মালিক ছুঁড়ে দিচ্ছে অর্ধভুক্ত মাংসের হাড়, আর নীচে দাঁড়িয়ে আমরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করছি কে কত উঁচুতে লাফ দিয়ে ওই ছুঁড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট লুফে নিতে পারব। যে আজকে মাংসের টুকরোটা পাচ্ছে, কাল সে লাফাতে পারছে আরেকটু বেশি। আর যে পারছে না, সে অক্ষম আক্রোশে কামড়ে ধরছে পাশের জনের ঘাড়।
যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নেই যে সার্ভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেস্ট, জীবনে প্রতিযোগিতা করেই টিঁকে থাকতে হবে, কিন্তু নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাওয়া যাচ্ছে কি? প্রাইভেট এয়ারলাইন্স জেট এয়ারওয়েজ প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে দশহাজার কোটি টাকা দেনার দায়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এসবিআই ও অন্যান্য সরকারি ব্যাংক শুধু সেই ঋণ মুকুবই করছে না, উপরন্তু আরও দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে। অন্যদিকে সরকারি বিএসএনএল ছাঁটাই করতে চলেছে তাদের পঞ্চান্ন হাজার কর্মীকে। একদিকে রাফায়েল ডিল পাচ্ছে দেনায় ডুবে থাকা অনিল আম্বানি, অন্যদিকে সরকারি সংস্থা হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) চলে যাচ্ছে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে। ইতিহাসে প্রথমবার কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য অন্যতম ধনী ও সফল সরকারি সংস্থা হ্যালকে বাজার থেকে ধার করতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু কেন হ্যালের এই অবস্থা? কি করে পৌঁছল ক্যাশ রিচ হ্যাল এমন অবস্থায়?

সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৪

লাল ফিতার ফাঁস ও কয়টা নিঝুম স্কুলবাড়ি ~ বিহঙ্গ দত্ত

২০১৫-১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের আমলে এসএসসি-র সবচেয়ে বড় এক্সামটা সংগঠিত হয়। তিনটে পার্টে শিক্ষক নিয়োগ করার কথা হয়েছিল। 

১) পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পোস্ট ফর ইলেভেন টুয়েলভ 
২) অনার্স গ্র্যাজুয়েট পোস্ট ফর নাইন টেন 
৩) প্লেন গ্র্যাজুয়েট পোস্ট ফর আপার প্রাইমারি 


এর মধ্যে আপার প্রাইমারির রেজাল্ট এখনও বের করতে পারেনি রাজ্য সরকার। আশা রাখছি ২০৫০-র মধ্যে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। 

কিন্তু বাকি দুইটো প্যানেলের রিক্রুটমেন্ট হয়। একজন পরীক্ষার্থী হিসাবে আমিও ছিলাম অগুন্তি চাকুরিপ্রার্থীর ভিড়ে। নম্বর নেহাত মন্দ পাই নাই। কিন্তু ইন্টারভিউতে ডাক আসেনি। যাদের এসেছিল তাদের মধ্যে মুড়ি মিছরি বাছতে বসা আমার কম্ম না। কিন্তু কানাঘুষায় শুনি বেশিরভাগই ১০০% উত্তর করে এসেছে। প্রশ্নটা ঠিক ১০০% করে আসার মত ইজি ছিল না। কিংবা হয়তো ছিল। মধ্যমেধার মানুষ আমরা। এ বিপুলা পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি? 

 যাই হোক, রিক্রুটমেন্ট হল। তখন তৃণমূলের দ্বিতীয় টার্ম। বিরোধীপক্ষ পর্যুদস্ত। বিজয়রথ চলতে থাকল। আবারও কানাঘুষায় শোনা গেল দরদাম করা উচিত না। কেননা এ হল লাইফ সেটলমেন্ট। বাঁধা দামে বাঁধা চাকরি হচ্ছে। স্ল্যাব নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সঠিক মূল্যে সঠিক জিনিস কিনে সর্বমোট (গ্রূপ সি, গ্রূপ ডি চাকুরিজীবী ধরে) ২৫০০০ মতো নিয়োগ হল। কেউ বা ঘরের কাছে। কেউ বা একটু ব্যাজার মুখে খানিকটা দূরে। আমরা বসে রইলাম আরেকবারের আশায়। আমাদের থেকেও মরিয়া ছিল অনেকে। তারা কোর্টে গেল। এরপরের ইতিহাস আপনারা গত আটবছরের ব্রেকিং নিউজে দেখে আসছেন। আলাদা করে বলার কিছু নেই। 


আজ আটবছর পার হয়েছে। আবারও একটা ঐতিহাসিক রায় এসেছে। আগেও অনেকগুলা এসেছিল। এই রায়দান কিছুটা বিশেষ কেননা এখানে কোর্টও আমার জায়গায় নেমে এসেছে। মুড়ি মিছরি বাছেনি। এর আগে এই রায় একবার সুপ্রিম কোর্টে গেছিল। ফিরে এসেছে। আজ আবার বছর ঘুরে ফিরে এল একই গেরোয়। তাদের হাতে তিনটে অপশন ছিল। 

১) যেরকম চলছে সেরকম চলতে দেওয়া 
২) যোগ্য অযোগ্য প্রার্থী বাছা 
৩) পুরা প্যানেল ক্যানসেল করা 

১ আর ৩ নং অপশন গ্রহণ করা  এক মিনিটের কাজ। ২ নং কাজই কঠিন। কিন্তু সেই কাজটি করানোর জন্যই লোকে কোর্টে যায়। 
আজ বিজেপির কোনও নেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন যে কী করা উচিত? বলবে প্যানেল আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ। সবকটারে ধরে ক্যান্সেল করা। 
তৃণমূলের নেতার কাছে যান। সোজা বলবে আমরা সততার প্রতীক। যেমন চলছে সেটাকেই স্বীকৃতি দেওয়া। 
সাধারণ মানুষের কাছে যান। যেটা শুনতে পাবেন সেটা হল যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি হোক। তাই নিয়েই আট বছরের লড়াই। 

কিন্তু কমিশন সেটা করতে দেবে না। কমিশন নিজেদের দায় এড়াবে। ঘোরাবে। যোগ্য প্রার্থীদের টেনে নামাবে অযোগ্যদের পাঁকে। ওএমআর বের না করার জন্য জান লাগিয়ে দেবে। কেননা নিজেদের মুখ পোড়াবার চাইতে, জেলের ঘানি টানার চাইতে হাজার হাজার চাকুরিজীবীকে যূপকাষ্টে তোলা অনেক বেশি সহজ। 

এত শত ঢাকাচাপা দেওয়ার পরেও ৫৫৭৩ জনের ঘাপলা ঢাকা যায়নি। তারা কেউ ফাঁকা ওএমআর দিয়ে চাকরি পেয়েছে। কেউ মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল লিস্ট থেকে সুপার নিউম্যারিক্যালি ডাক পেয়েছে। কেউ বা দারুণ বুদ্ধি খাটিয়ে পেছনের র‍্যাঙ্ক থেকে লং জাম্প মেরে ঢুকেছে মেইন লিস্টে। এদের টাকা ফেরত দিতে হবে চাকুরিজীবনের। একশোবার ভালো হয়েছে। 

কিন্তু বাকিদের অভিযোগ কি প্রমাণিত? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে আরও ২০০০০ র মধ্যে ১৫০০০ ই অযোগ্য এবং ঘুরপথে ঢুকেছে তারপরেও বাকি পাঁচ হাজারকে কেন এই নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে? কেন তাদের বারবার দেখে যেতে হবে স্টে অর্ডার পড়ল কিনা? তাদের সততার দাম নেই? সমাজের চোখে তারা যে নিচু হয়ে গেল এই মুহুর্ত থেকে এর কোনও দাম নেই? 

এই প্রত্যেকটা চাকুরিপ্রার্থীর সততাকে বেচেছে কমিশন। তাদের দাঁওয়ে রেখে অযোগ্যদের আড়াল করার চেষ্টা করে গেছে এবং যাচ্ছে। 
এবং আপনি! মহামান্য হাইকোর্ট! আপনারা এতদিন সময় পেয়েও সবরকম তদন্তের স্বাধীনতা পেয়েও এই কতিপয় সৎ চাকুরিজীবীকে সিকিওর করতে পারেননি। অতটা চাপই দিতে পারেননি কমিশনকে। 

এই সব লেখার পর একটু থামতে হল। খানিক মনোবল জোগাতে লাগে। কেননা বাকি গল্পটা বড্ড করুণ। এই রায়ে আবার স্টে অর্ডার পড়বে। তারপর আবার একটা দুটো। শেষ অব্দি হয়তো চাকরি যাবে অনেকের। কিংবা কয়েকজনের। লাল ফিতার ফাঁস আরও কড়া হয়ে বেড়ি পড়াবে স্কুলশিক্ষাকে। গান্ধীমূর্তির পাদদেশের চাকুরিপ্রার্থীরা কাঁদছিলেন এক অদ্ভুত প্রতিহিংসায়। তারা জ্বলেছেন এতদিন। আজ জ্বলতে দেখছেন তাদের ভাত মারা সেইসব অযোগ্যদের। কিন্তু তারপর? বারকয়েক সাংবাদিকরা এই প্রশ্নটা করায় এক মুহূর্তে শূন্যতা নামল চোখে। প্যানেল ক্যানসেল হচ্ছে। প্যানেল ক্যানসেল? না, এতদিন যে ওএমআর পাওয়া যায়নি সেটাকে নাকি খুঁজা আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাহলে এতদিন হয়নি কেন? এই রায় দিতে হল কেন? 
এরপর? এদের আর সেই বয়স নেই। সেই খাটার ক্ষমতা নেই। সেই যোগ্যরা যাবে কোথায় যারা বসে আছে? অপেক্ষা করবে আর একটা ন্যায় বিচারের? আরও কোনও ধর্ণামঞ্চে? 

আর বসে থাকবে কিছু আধফোটা মুখ। নিঝুম স্কুলবাড়িতে বিকালের ছায়া দীর্ঘ হয়ে আসবে। শিক্ষক নেই। শিক্ষক নেই বলে ছাত্র নেই। ছাত্র নেই বলে শিক্ষক নেই। এই ক্রমান্বয়ী লুপে কতগুলো পরিবারের রমেশ, আলতাফ, রাবেয়া, রোকসানারা মোট বাঁধবে পরিযায়ী হওয়ার জন্য। ফেলে রেখে যাবে পেন-পেন্সিল, পড়াশুনার বইপত্র, ঘরের আঙিনা আর প্রিয় বাংলাকে।

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পাগলা দাদু ~ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

"ইরিব্বাবা, ইরিব্বাবা," 
বলেই দাদু লাফ মারেন; 
তারপরেতেই চুলকে কনুই 
ফোঁশফোঁশিয়ে হাঁফ ছাড়েন!

ওমনি আবার ডাইনে ঘুরে 
চমকে ওঠেন কাক দেখে,
তাইতে কেমন তৃপ্ত হয়ে 
ঘুমিয়ে পড়েন নাক ডেকে!

ঘন্টা পাঁচেক ঘুমিয়ে নিয়ে 
ওঠেন হঠাৎ খাট ছেড়ে,
আনিয়ে খাবার গিলতে থাকেন 
গপ-গপিয়ে, পাত পেড়ে;

খাবার খেয়েই ঢেঁকুড় তুলে, 
বাহান্ন বার কান মলে,
ধর্মতলার রাস্তা ধরে 
হন-হনিয়ে যান চলে।

ওই যেখানে সবাই বসে 
ধর্ণা দিয়ে গান শোনে,
সেই সেখানে গিয়েই দাদু 
মুণ্ডু নাচান আনমনে;

ওমনি হঠাৎ সামনে ঝুঁকে 
উলটো হাতে কান ঘষে
এদিক সেদিক তাকিয়ে নিয়ে
দিদির পাশে যান বসে।

এ সব দেখে ভাইরা শুধোয়, 
"কি দাদু, কি ধান্দাটা?"
ক্লান্ত হেসে বলেন দাদু, 
"জানিস, আমি মান্ধাতা?

হাজার হাজার বছর ধরে 
শুনছি তোদের গুলতানি,
সবাই তোরা পানসে গরু, 
যতই সাজিস মুলতানী!

দাদার কথায়, দিদির কথায়, 
লাফিয়ে বেড়াস দিগ্‌বিদিক,
মারবে তোদের ভোজপুরী ল্যাং, 
ঠেকেই তোরা শিখবি ঠিক!

ক্যান্‌ রে তোরা দুচোখ বুজে 
ওদের কথায় চলতে চাস?
ভাবনা নিজের চুলোয় দিয়ে 
ওদের কথাই বলতে যাস?

এই দুনিয়ায় প্রশ্ন কত, 
আর কবে ভাই খুঁজবি রে?
কিছুই তোরা জানিস নে ভাই, 
আর কবে ফের বুঝবি রে?

জানিস কেন সর্ষে ইলিশ 
ভাপিয়ে খেলে ভাল্লাগে?
জানিস তোরা টক কেন কুল? 
লঙ্কা কেন ঝাল লাগে?

কক্ষণও কি দেখিস ভেবে, 
পায়রা কেন উড়তে চায়?
পতঙ্গরা আগুন দেখে 
বৃথাই কেন পুড়তে যায়?

হঠাৎ কেন ব্যর্থ প্রেমিক 
পদ্য লেখে শ্বাস ফেলে?
মুখটা কেন পেঁচিয়ে ওঠে 
চুন মাখিয়ে ঘাস খেলে?"

এই না বলে হঠাৎ দাদু 
থমকে গিয়ে, নোখ খুঁটে,
ফ্যাল-ফ্যালিয়ে তাকিয়ে দেখেন 
চতুর্দিকে, চোখ ফুটে;

ওমনি আবার 'ডুম-ডুমা-ডুম' 
বাজিয়ে নিয়ে ড্রামখানা
মালকোঁচাটা বাগিয়ে ধরে 
যান পালিয়ে নামখানা!!

বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৪

পিটার হিগ্স ও ঈশ্বর কণা ~ অরিজিৎ গুহ

২০১২ সালের জুলাই মাসে সার্ন ঘোষণা করল প্রায় ৫০ বছর আগে যা ছিল অপ্রমাণিত তত্ত্ব, অথচ যা মিলিয়ে দিয়েছিল মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র কণিকাদের পারিবারিক কুণ্ডলী, তা এখন পরীক্ষালব্ধ বাস্তব। আবিষ্কার হয়েছে " হিগস বোসন " যার ডাকনাম " গড পার্টিকল"। বাংলা সংবাদ মাধ্যমে উল্কার গতিতে ছড়িয়ে গেল খবর " ঈশ্বর কণা আবিষ্কৃত"। সেই সূত্র ধরে, মনের মাধুরী মিশিয়ে চর্চা চলতে লাগল এ নাকি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ। বিশ্বাসী মানুষ খবর কাগজ পড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন " যাক! তিনি আছেন। বিজ্ঞানকে পর্যন্ত তাঁকে স্বীকার করতেই হল।" রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশে অনুচ্চারিতই রয়ে গেল যে " ঈশ্বর কণা" নিছকই নাম, " হতচ্ছাড়া" ( Goddamn) কে সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করা বৈ কিছু নয়।
যার দৌলতে " ঈশ্বর কণা " কটাদিন বাঙালির মনোজগতে তুফান তুলল সেই পিটার হিগস মারা গেলেন গত পরশু। বাংলা সংবাদমাধ্যমে কোন খবর আছে " ঈশ্বরের" আবিষ্কারককে নিয়ে? থাকার কথাও নয়। এখন তো আর " সেনসেশন " তৈরি হবে না।
যাইহোক, পিটার হিগস এবং তাঁর আবিষ্কার নিয়ে সহজ ভাষায় লিখেছেন অরিজিৎ গুহ। নিচে দিলাম লেখাটা।
~ শুভ্রদীপ ঘোষ 
******"************************************************



আত্মবিশ্বাস শব্দটার সাথে জড়িয়ে থাকে একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব। আত্মবিশ্বাস না থাকলে সুন্দর কোনো কিছুই গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। পল ডিরাক যখন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে প্রথমবার বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ যুক্ত করলেন, তখন তাঁর ইকুয়েশনের সলিউশনে একটা অদ্ভুত ফলাফল এসেছিল। দ্বিঘাত সমীকরণে x এর যেমন পজিটিভ এবং নেগেটিভ দুখানা মাণ বেরোয়, অনেকটা সেরকমই। সমীকরণটায় ইলেকট্রনের দুখানা চার্জ বেরিয়েছিল। একটা নেগেটিভ এবং একখানা পজিটিভ। নেগেটিভ চার্জ নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। চিন্তার কারণ ঘটিয়েছিল পজিটিভ চার্জখানা নিয়ে। ইলেকট্রন কী করে পজিটিভ চার্জের হয়! অদ্ভুত ব্যাপার! ডিরাক নিজেও প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলেন। ভেবেছিলেন এটা পজিটিভ প্রোটনেরই হয়ত কোনো প্রকারভেদ হবে। আবার অংক কষা শুরু করেছিলেন। পরে স্থির প্রত্যয় হয়ে ঘোষণা করেন, আমার সমীকরণ পুরোপুরি ঠিক। একফোঁটা কোনো ভুল নেই।

কিছুকাল পরে কার্ল অ্যান্ডারসন ইলেকট্রনের অ্যান্টি পার্টিকল পজিটিভ চার্জের পজিট্রন আবিষ্কার করেন ক্লাউড চেম্বারে কসমিক রে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে। ডিরাক বললেন My equations are more powerful than me. আত্মবিশ্বাস। আমিই ঠিক। এই আত্মবিশ্বাসের ফলে পাওয়া গেছিল সুন্দর একটি তত্ত্ব। অ্যান্টি পার্টিকল এর তত্ত্ব।
১৯৯৮ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের তত্ত্বাবধানে নয় বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটার বা পার্টিকল কোলাইডার তৈরি করা হল মহাবিশ্বের কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য যার নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। যেসব প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হচ্ছিল তার মধ্যে ছিল কণা পদার্থবিজ্ঞানের এখনো অব্দি সব থেকে সর্বজনগ্রাহ্য মত স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল এর মান্যতা নির্ধারণ এবং স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলের সম্প্রসারিত মতবাদ সুপারসিমেট্রির সন্ধান, স্ট্রিং থিওরিতে বর্ণিত অতিরিক্ত মাত্রার সন্ধান, ডার্ক ম্যাটার যা ধরে আছে মহাবিশ্বের ৭৮ শতাংশ ভর সেই ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান, গ্র্যাণ্ড ইউনিফাইড তত্ত্ব ইত্যাদি। তবে সব থেকে বড় যে প্রশ্নের উত্তরটা খোঁজা হচ্ছিল সেটা হচ্ছে পদার্থের ভর সংক্রান্ত।


কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল আসলে পর্যায় সারণির মৌলের মত প্রাথমিক কণার একটা পর্যায় সারণি। এই পর্যায় সারণির প্রায় প্রতিটা কণাই নয়ের দশক নাগাদ পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটারে আবিষ্কৃত হয়ে যায়। বাকি ছিল একখানা কণার আবিষ্কার। সেই কণাটা আবিষ্কৃত হলেই এক বিরাট বড় মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়ে যেত পদার্থবিদদের। প্রশ্নটা কী ছিল! একটু দেখে নেওয়া যাক।
ধরা যাক ইলেকট্রন। এটা একটা প্রাথমিক কণা এবং স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলে যে পর্যায় সারণি করা হয়েছে সেখানে এর স্থান রয়েছে লেপটন কণাদের শ্রেণীতে। বাকি লেপটন কণারা হচ্ছে মিউয়ন আর টাউ। এরা খুব হাল্কা কণা। এবার রিচার্ড ফেইনম্যান কোয়াণ্টাম তত্ত্বের মধ্যে ফিল্ড থিওরি বলে একটা তত্ত্ব এনেছিলেন যেখানে উনি দেখিয়েছিলেন প্রতিটি কণার সাথে যুক্ত থাকে একটা করে সেই কণার ফিল্ড। ফিল্ড মানে হচ্ছে যেখানে সেই কণাটার উপস্থিতি বোঝা যায়। 'পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাঙ খোড়া করে দেবে বলেছে পাড়ার দাদারা'- এই গানের মধ্যে দিয়ে অঞ্জন দত্ত পাড়ার দাদাদের ফিল্ড বুঝিয়ে দিয়েছেন। ওই পাড়াটাই হচ্ছে দাদাদের ফিল্ড। ওখানে দাদারা শক্তিশালী। সেরকমই কণাগুলোরও একেকটা ফিল্ড রয়েছে এবং এই ফিল্ডের ফ্লাকচুয়েশনই কণার অস্তিত্ত্ব প্রকাশ করে। এই ফিল্ডের মধ্যে কণাটা শক্তিশালী।

কণার অস্তিত্ত্ব তো প্রকাশ হল, কিন্তু কণা সাবালক হল কিনা কী করে বোঝা যাবে! অর্থাৎ কণাটা ভর পেল কিনা সেটা কোথা থেকে জানা যাবে! এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা পড়লেন দ্বিধায়। তাঁরা প্রস্তাব করলেন কণাগুলো জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে একটা চ্যাটচ্যাটে আঠালো ফিল্ড যা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র, সেই ফিল্ডের মধ্যে দিয়ে যায়। এবার সেই আঠালো চ্যাটচ্যাটে ফিল্ডের সাথে অন্য কণার ফিল্ডের মিথষ্ক্রিয়া বা ইন্টার্যাকশন যখন হয় তখন কণাগুলো এমন ভাব করে যেন সুইমিং পুলের মধ্যে কণাগুলো সাঁতার কেটে জল ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সাঁতার কাটার ফলেই কণাগুলো তার ভর পাচ্ছে। ওই সুইমিং পুলটা হচ্ছে সেই আঠালো চ্যাটচ্যাটে ফিল্ড। রাশিয়ান পদার্থবিদ লেভ ল্যাণ্ডাউ এর নিম্ন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহিতার একখানা তত্ত্ব থেকে এই চ্যাটচ্যাটে আঠালো ফিল্ডের তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা নিয়ে আসেন। এই যে কণাগুলোর এই ফিল্ডের সাথে মিথষ্ক্রিয়া বা সাঁতার কাটার এই পদ্ধতি, সেই সংক্রান্ত কয়েকখানা পেপার ১৯৬২-৬৪ এর মধ্যে পরপর কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রকাশ করেন। তাঁদের প্রত্যেকের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী এই মিথষ্ক্রিয়ার নাম রাখা হয় ABEGHHK'tH mechanism. যথাক্রমে Philip Anderson, Robert Brout, Francoise Englart, Gerald Guralnik, CR Hagen, Peter Higgs, Tom Kibble, Gerard tHooft এদের আদ্যাক্ষর অনুসারে। তবে এদের মধ্যে খুব স্পষ্টভাবে পিটার হিগস তাঁর পেপারে এই ফিল্ড সংক্রান্ত যে একটি কণা রয়েছে তার উল্লেখ করেন। স্বাভাবিক। ফিল্ড থাকলে সেই ফিল্ডের একটা কণাও থাকবে। সেই জন্য পরবর্তীকালে এই মেকানিজম হিগস মেকানিজম আর হিগস ফিল্ড সংক্রান্ত কণাটাকে হিগস কণা বলে উল্লেখ করা হতে থাকে। স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলের বাকি বল বা ফোর্স পরিবাহী কণাগুলো যেগুলো বোসন কণা তার সাথে এই কণাটার একটা পার্থক্য হচ্ছে বাকি ফোর্স ক্যারিয়ার কণাগুলোর ফিল্ডের একটা অভিমুখ আছে, যেহেতু ফোর্স বা বলের অভিমুখ থাকে, তাই বাকি ফোর্স ক্যারিয়ার কণাগুলো হচ্ছে ভেক্টার বোসন বা গেজ বোসন আর এই কণাটার কোনো অভিমুখ নেই তাই একে বলা হয় স্কেলার বোসন। এবং এই কণাটাই সব কণাদের ভর যোগাচ্ছে। এলএইচসি তে যদি এই কণা আবিষ্কার করা যায় তাহলে পদার্থের ভর সংক্রান্ত একটা মৌলিক প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে।
যখন এলএইচসি তৈরি হচ্ছে ততদিনে স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল নিয়ে গবেষণা করে বেশ কয়েকজন নোবেল পেয়ে গেছেন। তার কারণ আগেই উল্লেখ করেছি বাকি কণাগুলো পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটারে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। যারা যারা এইসব কণা সংক্রান্ত তত্ত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা এবং যারা কণাগুলোর আবিষ্কারে জড়িত ছিলেন, প্রত্যেকেই নোবেল পেয়ে গেছেন। সেই সময়ে পদার্থবিদদের মধ্যে একটা বিকল্প তত্ত্বও উঠে এসেছিল যা হচ্ছে হিগস মেকানিজম এবং হিগস বোসন ছাড়া পার্টিকল ফিজিক্স এর ইলেকট্রোউইক তত্ত্ব। এখানে বলা হয়েছিল কণাগুলোর কোয়ান্টাম ফিল্ডের যে গতিশক্তি সেখান থেকেই কণাগুলো নিজস্ব শক্তি থেকে ভর সৃষ্টি করে।এবং এই সংক্রান্ত ম্যাথামেটিক্সও বিকশিত হচ্ছিল ১৯৯০ থেকেই। সহজেই বোঝা যায় এই তত্ত্ব বিকশিত হলে স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হত এবং হিগস মেকানিজম বা হিগস ফিল্ডের আর কোনো অস্তিত্ত্বই থাকত না।
১৯৯৮ সালে এই বিকল্প তত্ত্ব নিয়েই সার্নে বক্তৃতা দিতে গেছিলেন বিকল্প তত্ত্বের উদ্ভাবক কানাডার পদার্থবিদ John W Moffat. সেই বক্তৃতার নাম ছিল Electroweak Model without a Higgs Particle. স্পষ্টতই সেই সময়ের প্রেক্ষিতে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এত বড় একটা প্রোজেক্ট হচ্ছে, তার আগে এমন একখানা বক্তৃতা যে বক্তৃতা পুরো প্রজেক্টটা সম্পর্কেই অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

সেই বক্তৃতার ঠিক আগে আগেই এই এলএইচসি প্রজেক্ট লঞ্চ হল। একজন সাংবাদিক তৎকালীন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসার পিটার হিগস কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই যে একটা নয় বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট যেখানে আপনার নামে একখানা কণা আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে, আপনি কি বিশ্বাস করেন এতে হিগস বোসন পাওয়া সম্ভব হবে? পিটার হিগস এর জবাব ছিল I am 96 percent certain that they will discover the particle.

Moffat এর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর সার্নের থিওরেটিকাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলের সেমিনার রুম স্তব্ধ হয়ে গেছিল। এসব কি তত্ত্ব শুনছে ফিজিক্স কমিউনিটি! এই তত্ত্বের ঠিক হওয়া মানে নয় বিলিয়ন ডলার জলে চলে যাবে। সরকারের থেকে ভবিষ্যতে আর কোনো ফাণ্ড পাওয়া সম্ভব হবে না। পার্টিকল ফিজিক্স এর গবেষণা থমকে যাবে! কিন্তু ফিজিক্স তো এভাবে চলে না! সেমিনার রুমের এক বিজ্ঞানীর প্রশ্নের জবাবে Moffat বলেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে যদি মিকেলসন মর্লি ইথার কে নস্যাৎ না করতেন তাহলে আইনস্টাইন এর রিলেটিভিটির জন্ম হত? সাইন্স আসলে কোনো কণা পেলাম কি পেলাম না তার ওপর নির্ভর করে থাকে না। এত বড় প্রোজেক্ট যদি ফেলও করে তাহলেও সাইন্স এগিয়ে যাবে।

অবশেষে ২০১৩ তে সার্নের এলএইচসিতে আবিষ্কৃত হয়েছিল হিগস কণা। পূর্ণতা পেয়েছিল স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল। পিটার হিগস এর আত্মবিশ্বাস 'আমিই ঠিক' প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
গতকাল ৯ই এপ্রিল চলে গেলেন ২০১৩ র নোবেল প্রাইজ বিজয়ী পিটার হিগস। তিনি নিজে অবশ্য হিগস বোসন এর আবিষ্কারে পুরোপুরি নিজেকে কখনই কৃতিত্ব দেন নি। হিগস মেকানিজম এর পেপারের বাকি বিজ্ঞানীদের কথাও সব সময়ে বলে গেছেন। নিজেকে অন্তরালে রাখতেই পছন্দ করতেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই প্রফেসার।

শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পারি কমিউন ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

২৯ শে মার্চ, সকালে দুই লক্ষ 'হতভাগা' তাদের  নির্বাচিত প্রতিনিধিদের টাউন হলে অধিষ্ঠিত করার জন্য জড়ো হল। বাজনা বাজে - রক্ষী বাহিনীর সঙ্গীনের মাথায় লাগানো ছোট ছোট লাল পতাকা। শোভাযাত্রা করে চারধার থেকে সৈনিক আর নাবিকরা আসছে। মানুষের হাজারো ছোট স্রোত মিলিত হয়ে সৃষ্টি করল এক জনসমুদ্র। রক্ষী-বাহিনীর সঙ্গীনে সূর্যকিরণের ঝলমলানি। সভামঞ্চ অগণিত পতাকায় সাজানো - লালপতাকার ভিড়ের মধ্যেও দু-একটা ত্রিবর্নরঞ্জিত পতাকাও রয়েছে। গানে গানে মুখর এই সব- ব্যান্ডে লা-মার্শাই এর সুর: বিউগল বেজে উঠল - কামান দাগার সংকেত। কমিউনের কামান গর্জন করে উঠল।

মঞ্চে একে একে উপস্থিত হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আর কমিউনের সদস্যবৃন্দ। সকলের গলায় লাল স্কার্ফ জড়ানো। রেনভিয়ে সভা উদ্বোধন করলেন, "নাগরিকবৃন্দ, আমার হৃদয় আজ আনন্দে ভরে উঠেছে - আমি আনন্দে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছি। আপনাদের অনুমতি নিয়ে, আমি প্যারিসের মানুষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁরা গোটা পৃথিবীকে পথ দেখালেন।"

তারপর নির্বাচিত সদস্যদের নাম পড়া হল। কমিউনের লাল পতাকাকে অভিবাদনের বাজনা বেজে উঠলো। দু লক্ষ লোক সমস্বরে মার্শাই গেয়ে উঠল। আবার নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে রেনভিয়ে-র কন্ঠ থেকে নির্গত হল: "জনগণের নামে আমি কমিউনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম।" সহস্রকণ্ঠে প্রতিধ্বনি - কমিউন দীর্ঘজীবী হোক ! ভিভা লা কমিউন !! পৃথিবী নামক গ্রহের বুকে মানুষ নামক জীব তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পার্টিসিপেটরি ডেমোক্রেসির স্বাদ পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত। 

আজ এত বছর বাদে আবার এক ২৯সে মার্চ আমরা যদি ফিরে দেখি তাহলে আবেগের থরথর রূপকথাসম এই ইতিহাস থেকে রুক্ষ বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়তে  বাধ্য আমরা কারণ আমরা জানি যে সেই কমিউন, পারি কমিউন, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দু'মাসের বেশি বাঁচে নি। তাকে প্রতিবিপ্লবীরা রক্তে ডুবিয়ে মেরেছিল।  তাহলে কি রেনভিয়ে সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলেন ?

না। উনি মিথ্যে বলেন নি। পারি কমিউন দু'মাসের বেশি বহাল থাকতে পারে নি এটা ঠিক, কিন্তু সেটা সারা পৃথিবী জুড়ে খেটে খাওয়া মানুষের মনে একটা বিশ্বাস তৈরি করে দিয়ে গেছে। নির্বাচন মানেই হল দুটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে লড়াই। জনগণের হাতে আর কোনও অপশন নেই, তাকে শাসনকর্তা হিসেবে ওই দুটো দলের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে এই বাইনারীর তত্বকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পারি কমিউন। লেসার ইভল - কম শয়তানদের হাতে আমার জানমালের দায়িত্ব তুলে দিতে বাধ্য নই। আমরা নিজেরাই সক্ষম নিজেদের শাসন করতে - এই বোধ জাগিয়ে তুলেছিল পারি কমিউন। শ্রমিক -কৃষক- মধ্যবিত্তদের নিয়ে তৈরি করা রাজনৈতিক মঞ্চের হাতে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার ভোট দিয়ে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল জনগণ।

লেসার ইভল - কম শয়তান খুঁজতে আমি আপনি বাধ্য একথা যারা প্রচার করে তাদের সেই তত্ত্বের ওপর সপাটে একটা থাপ্পড় এর নাম পারি কমিউন। পারি কমিউন ইজ ডেড। লং লিভ পারি কমিউন।

শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

একটি ল্যাম্প পোস্ট এবং ৬২৩টি মেয়ে ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

পাশের বাড়ির বৌদি, বিগত যৌবনা হলেও সাজগোজ করতে কিঞ্চিৎ ভালোবাসেন। আপনি আড় চোখে দেখেন আর পাড়ার চায়ের ঠেকের খাপ পঞ্চায়েতে তাকে আখ্যা দেন ঢলানি মেয়েছেলে বলে। অফিসে নতুন কাজে জয়েন করা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সবার সাথে মেলামেশা করছে দেখে আপনি তাকে আখ্যা দেন বেহায়া বলে। বন্ধু'র কনিষ্ঠ কন্যা, সদ্য কলেজ ছাত্রীকে জিন্স পরতে দেখলে, সিগারেট ফুঁকতে দেখলে আপনার স্থির সিদ্ধান্ত হয়, মামনি গোল্লায় গেছে। শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত দেখলে আপনার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় পশ্চিম ইউরোপের ইতালিতে মেয়েদের দেখে আপনার মতো কিছু নীতি পুলিশ সাজা কাকু/ কাকিমা ওই সিদ্ধান্তে আসতেন যে ওদেশের মেয়েগুলি কিঞ্চিৎ বেহায়া, ঢলানী ও বয়ে যাওয়া এম্পটি হেডেড। অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন ওদেশের সেই মেয়েগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় কি অবাক কান্ডই না ঘটিয়ে ছিল। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ওই ইতালি দেশটাতেই ফ্যাসিবাদ নামক কুখ্যাত মতবাদের জন্ম। ইউরোপের আর পাঁচটা দেশেও ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওই দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী, যাদের পার্টিজান বলে, সেটা গঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু আপনার কি জানা আছে যে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সংগ্রামী মানুষ দ্বারা গঠিত সেই বাহিনীর  এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ সদস্য ছিল মহিলা ? যারা পুরুষ কমরেডদের পাশাপাশি স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই দিয়েছিল ? আজ্ঞে হ্যাঁ যেই "বেহায়া", "ঢলানি" "মেয়েছেলে"র দল। আপনাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে যে ওই মেয়েদের মধ্যে চার হাজার ছশ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, দু হাজার সাতশো পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওই মহিলাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি কিন্তু। ফ্যাসিবাদীদের পরাজয় হয়েছিল। আঠাশ এপ্রিল, ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নায়ককে পার্টিজানরা গুলি করে মারে। মেরে ফেলে দিয়ে যায় মিলান এর প্রধান রেল স্টেশনের চত্বরে। যার পরে ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা পাশবিক আক্রোশে সেই একনায়কের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় ল্যাম্পপোস্টে, জনতা জড়ো হয়ে উল্লাস করে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এর পরে সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েরা বন্দুক ফেলে ফিরে যায় অভ্যস্ত জীবনে, ঘরকন্নয়, গেরস্থালির কাজে, মাঠে ফসল তোলার কাজে, ফ্যাশন শো এর রেম্পে। ফেরেনি কেবল ফ্যাসিস্ট/ নাৎসি বাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করা ছশো তেইশ জন মহিলা পার্টিজান। কোনো অজানা সবুজ পাহাড়ের কোলে, আরো সবুজ শান্ত গাছের ছায়ায় তারা চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাদের মিনি স্কার্ট হাই হিলের খুট খুট শব্দে মুখরিত হবে না আর মিলানের পাথর বাঁধানো রাস্তা। যখনই কেউ "ঢলানি মেয়েছেলে" দের শরীর নিয়ে কথা বলে, মেয়েদের "ডিগনিফায়েড" বেশভূষা নিয়ে জ্ঞান দিতে আসে তখনই কেন জানি সেই মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। গুডবাই বিউটিফুল। বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও।

সন্দেশখালির সাতকাহন ~ রাধাবল্লভ রায়


রায়মঙ্গল-কলাগাছি নদীর কূল ধরে সন্দেশখালির মণিপুর, আতাপুর, ধুচনিখালি, শীতলিয়া। এগুলি একটু পুরনো আবাদ। ওই ধরুন, গত শতকের প্রথম দিকে বা তার একটু আগে আবাদ হয়েছে। লট অঞ্চল। কলকাতার বাবুদের পয়সায় বন-জঙ্গল কাটা হয়েছিল। দারুণ জমি সব। ধান হতো দেখার মতো। বছর সাত-আট আগেও সবুজ ধানের ক্ষেতে মায়াবি ঢেউ খেলে যেত। কিন্তু এখন সে সব নেই প্রায়। সবুজ ধানক্ষেতের জায়গায় ঘোলা-বোবা জল। সেই জলের বুকে ঢেউ ওঠে ঠিকই। কিন্তু সেখানে আকাশের ছায়া পড়ে না, সবুজশাড়ি পরা গ্রাম পুকুরের জানালায় উঁকি মারে না। বোবা-বধির ফিসারি মাঠ। অদ্ভুত এক আঁধারের মধ্যে সে শুধু টাকা প্রসব করে। কোটি কোটি টাকা। সে টাকার কোনও মা-বাপ নেই। জারজ। কিন্তু জারজ হলে কী হবে রাজা-বাদশারা তার কদর বোঝেন। এককালে এখানকার গরিব চাষিদের ঘামরক্ত ভেজা খাজনার পয়সায় জমিদারবাবুদের নাচমহলের ঝাড়বাতি গৌরব ছড়াত। কল্লোলিনী কলকাতায় টাকা উড়ত। আর এখন সন্দেশখালি-গোসাবার পাড়ায় পাড়ায় নাচমহল। ডান্স হাঙ্গামার মত্ত আসরে টাকা ওড়ে। জারজ টাকা। পাড়ায় পাড়ায় রাজা-বাদশা। ঘরে ঘরে শাহাজাদা। বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকে নাচনি আসে জুয়ামেলার জলসায়। সেখানে টাকা উড়িয়ে কোমর দোলান পঞ্চায়েত প্রধান, ডিলারবাবু, সমিতির নেতা থেকে ভেড়িমালিক সবাই। কম যান না পরিযায়ী শ্রমিকেরাও। আলোর ঝলকানির সঙ্গে ডিজে মিউজিক ডুম ডুম। তন্বী নৃত্যপটিয়সীর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জারজ বেহিসেবী টাকার চুম্বন, শীৎকার। তারপর অদ্ভুত অশ্লীল এক আঁধারের মধ্যে টাকাদের পাখনা হয়। তারা নতুন মহলবাড়ির চিলেকোঠায় উড়ে যায় সুখসন্ধানী কবুতরের মতো। আর জুয়ার নেশায় ফতুর হয় চাষির সন্তান। হারিয়ে যায় আবাদি মাটির নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। লোনাজল আর মাদকজল পাল্লা দিয়ে মুছে যায় সন্দেশখালির কয়েক প্রজন্ম ধরে অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি।  এবারে সর্বার্থে সর্বহারা হয় কৃষক। নিভে যায় তাঁদের কঠিন সংগ্রামের কথা। যে সংগ্রাম এগিয়ে চলেছিল আলোর পথে। বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির পথে।

      সন্দেশখালির ভুবন মণ্ডলের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। আমার বাড়ি সন্দেশখালি নয়। তবু ভুবন মণ্ডলকে আমি চিনি। সরকারপাড়ার ভুবন মণ্ডলের বয়স এখন সাতাত্তর। খুলনা জেলার পাইকগাছা থেকে এদেশে যখন এসেছিল তখন ওর বয়স ছিল সতেরো। হজরতবাল মসজিদের ঘটনা নিয়ে ওদেশে গোলমাল শুরু হতে ১৯৬৪ তে ওরা সপরিবারে হাসনাবাদে এসে ঠাই নিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে দণ্ডকারণ্য। কিন্তু ভুবন বাবা-মায়ের সঙ্গে যায়নি। শীতলিয়ার বাছাড় বাড়িতে গরু রাখালির কাজে ভর্তি হয় সে। বাছাড়েরা ধনী লোক। তিন-চারশো বিঘে জমি। ভুবন প্রথম বছর পেটেভাতে কাজ করত। তারপর এক সন্ধ্যায় নিতাই বাছাড়ের গিন্নিকে মা বলে ডাকায় ওর পদোন্নতি হয়। পেটেভাতের রাখাল থেকে মাহিন্দার। ছয়-সাত মণ ধানে সারা বছর খেটে দিত বাবুর বাড়ি। বেশি বেশি খাটত। বাবুরা সন্তুষ্ট হত তাতে। যা কিছু ইনকাম হত সব থাকত নিতাই বাছাড়ের গিন্নির কাছে। বছর চার-পাঁচ কেটে যায় এমনিভাবে। কিন্তু কথায় আছে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটল একটা। এক রাতে বাছাড় বাড়িতে ডাকাত পড়ল। লুঠ হয়ে গেল টাকা-পয়সা সোনাদানা। রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যায় অত বড় বাছাড়বাড়ি। মুখ শুকিয়ে গেল ভুবনের। তিল তিল করে জমানো হাজার কয়েক টাকা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে। জমি কিনবে, বিয়ে করবে। মা-বাবাকে দণ্ডকারণ্য থেকে বাংলায় আনবে। কিন্তু সে সব আর বোধহয় হল না। ভাগ্যলক্ষ্মী তার প্রতি কি এতটাই নির্দয় হবে! মাথার মধ্যে দলাপাকানো একটা চিন্তা টন টন করে ভুবনের। কিন্তু দুর্ভাগ্য একা পথ চলে না। সৌভাগ্যও তার পিছনে থাকে।

      এক সকালে অদ্ভুত এক আলো ভাদুরে ধান ক্ষেতে খেলা করছিল। ভুবন সেদিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। বাছাড়গিন্নি দোতলার জানালা থেকে দেখতে পায় তাকে। সেইদিন দুপুরে ভুবনের ভাগ্য ফেরে। একসঙ্গে অনেকটা আলো যেন তার দুর্গম যাত্রাপথটি সুগম করে দেয়। সন্দেশখালির সরকার পাড়ায় বাছাড়গিন্নির বাপের বাড়ি। কুসুম তার খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ে। ভুবনের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন তিনি। বিস্ময়ভরা চোখে সে ফিরে তাকাতে বাছাড় গিন্নি বলেছিলেন, " সাত নম্বরের কলোনিখাল পাড়ের চারবিঘে জমি তুই নে। সংসারধর্ম কর। তিনবিঘে জমি তোর টাকায়, আর এক বিঘে আমার আশীব্বাদ। যা।" ভুবন গিন্নিমাকে ঢপ করে একটা প্রণাম করতে বাছাড়গিন্নি ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল, "সবসময় আলোর পথে থাকবি। আঁধারে হাঁটবি না। তাহলি শান্তিতে থাকবি দেখিস। এইটি আমার পরামশ্য।"

      সে বছর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল। আর ভুবন শুরু করল নতুন জীবন। বাড়ি করল, বিয়ে করল, মা-বাবাকে মানা ক্যাম্প থেকে নিয়ে এল। তারপর অনেক কাল কেটে গেছে। দুই ছেলে আর দুই মেয়ে ভুবনের। নিজে হাতে তাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। জমির পরিমাণও বাড়িয়েছে কয়েক বিঘে। এখন সে বৃদ্ধ। খাটাখাটনি করতে পারে না আর। বড় ছেলের কাছে থাকে। কিন্তু মনে তার শান্তি নেই। তাহলে কি আলোর পথ থেকে সে বিচ্যুত হয়েছে? অথচ সারাজীবন বাছাড় গিন্নির দেখানো পথেই তো থাকতে চেয়েছে সে। নাতি-পুতিদেরও এগিয়ে দিতে চেয়েছে সেই পথে। তারা লেখাপড়া করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, জগতকে চিনুক। কিন্তু এইখানে ঘটে গেছে বিভ্রম। নতুন সময়ে ভুবনের ছেলেমেয়ে এবং নাতিপুতিরা কোন পথে চলেছে সে আর বুঝতে পারে না। ওরা জমি বোঝে না, টাকা বোঝে। শিক্ষা বোঝে না, স্ট্যাটাস বোঝে। শান্তি বোঝে না, ক্ষমতা বোঝে। সিভিক ভলেন্টিয়ার হয়েছে একজন। মোটরবাইকে গাঁক গাঁক করে ছোটে আর পাড়াসমেত চমকায়। পার্টির মিছিলে হাঁটে আর বোতল বোতল মদ খায়। পঞ্চায়েতবাবুদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। মান্যিগণ্যি করে লোকে। ভুবন এটাকে আলো বলবে না আঁধার বলবে বুঝে পায় না। অনুদানের টাকায় পাকা বাড়ি বানিয়েছে সেই নাতি। একটা নয়, দু-দু'খানা। কিন্তু বাড়ির মধ্যে লক্ষ্মীশ্রী নেই, শান্তি নেই। শান্তি নেই ভুবনের মনেও। জমিগুলো চলে গেছে সেখবাবুদের ফিসারিতে। লোনাজল তো বারণ মানে না কোনও। এক ঘেরিতে দু-চারজন রাজি হয়ে গেলে বাকি সকলের কপাল পোড়ে যে। ভুবনের সেই আলোর পথ, সাত বিঘে জমিও এখন লোনাজলের তলায়। কী করবে ভুবন?

      সাত বিঘে জমি থেকে লিজবাবদ বছরে আয় বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। দুই কিস্তিতে দুই ছেলে নগদানগদি বুঝে নেয়। ভুবন কিছুই বলতে পারে না। যে জমির সঙ্গে তার জীবন জড়িয়ে সেই জমি আর নেই ভাবতে গিয়ে কষ্ট হয় তার। কিন্তু নিরুপায় সে। সময়কে মেনে নিতেই হয়। চাষবাস উঠে যেতে ওর ছেলেরা এখন সংসার ছেড়ে মহারাষ্ট্রের নাসিকে। বিল্ডিং-এর কাজ করে। মাসে মাসে টাকা আসে বৌমাদের একাউন্টে। আবার সরকারি অনুদান আছে। মাসে মাসে রেশনের চাল, আয়লার চালও। ঘরে ভাতের অভাব নেই। তবু কোনও এক অজানিত কারণে বুকটা ধড়ফড় করে তার। সামনে কোথাও আলো দেখতে পায় না সে। নাতিরা বলে, "এ বুড়ো জমি জমি করে মরলো যে! বুদ্ধি হবে কবে তোমার? শ্মশানে গেলি? ভাবতি পেরেছিলে কোনওদিন পাকা ঘরে শোবে?" ভুবন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।

      ভুবনের বড়ছেলের ছোট মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে বিয়ে করেছে। শরীর হয়নি, তবু শাঁখা-চুড়িতে ঠমক দেয়। মেজ মেয়েটা ডান্স হাঙ্গামার দলের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তারপর বিহারের এক যৌনপল্লিতে তার খোঁজ মেলে। কিন্তু বাড়িতে ফেরানো যায়নি আর। ফিসফাস কানে এসেছে, মেয়েবাবদ এক লাখ টাকা পেয়েছে বড় ছেলে। সেই টাকায় ফ্রিজ আর রঙিন টিভি কিনেছে বড়বৌমা। ভুবন কিছু বলে না, শুধু দেখে। কেননা সে বুঝতে পারে না এগুলো আলো নাকি অন্ধকার। ছোট ছেলের ছেলেমেয়ে দুটো বই-খাতার বদলে রাতদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। হাসি-কান্না সব সেখানেই। খেলার মাঠ ছেড়ে ওরা মোবাইলে মজে থাকে। ছোট বৌমা কিছু বলতে দেয় না। এগুলি শেখা নাকি দরকার। এখানেও ভুবন নিরুপায়। আলো নাকি আঁধার সে ধোঁয়াশা ঘোচে না তার কিছুতেই। ছোট বৌমা গ্রামে হনুমান মন্দির বানানোর জন্য চাঁদা তোলে পাড়ায় পাড়ায়। কখনও মনে ভেবেছে ওটাই বোধহয় আলো। কিন্তু দু-চারদিন ছোট ছেলের বাড়িতে থাকার পর তার মোহভঙ্গ হয়েছে। এপাড়ার নতুন নেতা বিপ্লব হাজরার সঙ্গে ছোটবৌমা কলকাতায় যায় প্রতি সপ্তায়। ছেলের অনুপস্থিতিতে সে-ই এ বাড়ির মালিক। রাত কাটায় এবাড়িতে। গ্রামের লোকে পাঁচ কথা শোনায়। কিন্তু ভুবন বুঝে উঠতে পারে না আলো নাকি অন্ধকার। তাই কিছু বলা হয় না তার। ধানমাঠের লোনাজলের মতো অশান্তির ঢেউ রাতদিন ফেনা তোলে তার মুখের কাছে, বুকের কাছে। গ্যাস্ট্রিকের চুয়া ঢেকুরে পেট জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়। একটা লাঠি হাতে খালপাড়ে বসে শুকনো মাটির গায়ে দাগ কেটে যায় সে সকাল-বিকেল।

      ভুবনকে চেনা লাগতে পারে আপনাদের অনেকের। এত নিচে দৃষ্টি পড়ে না তো, তাই হয়ত মনে থাকে না। কিন্তু দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। গত কাল থেকে গ্রামে হরি নামের মহোৎসব চলছে। আটখানা মাইকের আওয়াজে হরিনাম হুঙ্কারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ফিসারি জলার বুকে। একবার হরি নামে যত পাপ হরে, জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে। হাজার হাজার মানুষ দু'বাহু তুলে নাচছে ওখানে। একে অপরকে জড়িয়ে জড়িয়ে কাঁদছে। ওই দলের মধ্যে ভুবন আছে নিশ্চয়ই। আলোর পথ খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা ওখানে অশ্রুধারায় গড়িয়ে পড়ছে জানি।


শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

কার্ল মার্ক্স ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

নিজেকে মার্ক্সিস্ট বলে দাবি করার খোয়াব কবেই মিলিয়ে গেছে ঠিক যেমনটা মিলিয়ে যায় সুগন্ধির সুবাস এক নিমেষে যখন দামী এসইউভি গাড়ির দরজা দড়াম করে খুলে দিলে। নিজেকে মার্ক্সসিস্ট বলে দাবি করার খোয়াব মিলিয়ে গেছে বাতাসে বিলাস বহুল বিয়েবাড়ির হাজার টাকা প্লেটের ডিনার শেষের তোলা তৃপ্তির উদগার এর মতো। নিজেকে মার্কসিস্ট বলে দাবি করতে হওয়ার মতো ধৃষ্টতার আর কিছুই অবশেষ বাকি নেই নাগাসাকি বিস্ফোরণ শেষের ধ্বংসস্তুপ এর মতো  দুনিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তবুও আজকের দিনটায় রাউল, রাউল ব্র্যাংকো কেন যেন ভেসে আসেন চিন্তা চেতনায় নিশির ডাকের মতো। পেরুর স্বৈরাচারী শাসক এর হাতে আগুনে আধপোড়া কবি রাউল মনে করেই দেন, মানুষ মারা গেলেও তার চিন্তা চেতনা বেঁচে থাকে, যদি তিনি হন পৃথিবী এর শ্রেষ্ট চিন্তা নায়ক। কার্ল মার্ক্স ইজ ডেড, লং লিভ কার্ল মার্ক্স।

কার্ল মার্ক্স
---------------------------
মার্ক্স, যখন পুঁজি গোটাচ্ছে তার তহবিল, ছড়াচ্ছে চিহ্ন জড়াচ্ছে ভূগোল, নগ্ন দিগন্তে ধেয়ে উড়ে চলেছে তার প্ৰযুক্তির ডানা;
তখন মার্ক্স, আপনার কণ্ঠস্বর আবারো গমগম করে, গমগম করে।

পুঁজি বারে বারে তারে তারে নাচে কুঁদে অকাতরে,
পুঁজি কর্ক ফুঁসে ওঠা কোকাকোলার বোতলে বোতলে,
পুঁজি নিকারাগুয়া থেকে নাইজেরিয়ার কারখানায়,
পুঁজি ফিক করে হাসা ফিকশনে ফিকশনে,
পুঁজি বেয়নেটে বিদ্ধ পোয়াতি নারীর পেটে,
পুঁজি টুপটাপ টুপটাপ রক্ত আর খুনের লাল ফিনকি,
পুঁজি বাজারে ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠা দানবীয় হাত,
পুঁজি খুবলে খাওয়া ডলারের দাঁত বসানো সাম্রাজ্যবাদ;
মার্ক্স, এখানেই অনিবার্য হয়ে ওঠে আপনার কণ্ঠস্বর, আবারো গমগম করে, গমগম করে।

বিপ্লবী শিল্পীদের ভায়োলিনে ভায়োলিনে জাগে আপনার তত্বের মূর্ছনা,
ফিলিপিন্সের গেরিলার বন্দুকে বন্দুকে বেরিয়ে আসে আপনারই তরতাজা অক্ষর সব, মহান মার্ক্স।

বদলাও পৃথিবী, পৃথিবী বদলাও, বদলাও পৃথিবী;
বুলেট ব'লে, বদলাও পৃথিবী,
প্রেম ব'লে, বদলাও পৃথিবী,
ঘৃণা ব'লে বদলাও পৃথিবী,
নদী ব'লে বদলাও পৃথিবী,
মা ব'লে বদলাও পৃথিবী।

তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিকের আর কৃষকের দেহে দেহে, ঘামে ঘামে, জবানে জবানে
আপনি মার্ক্স, ঝলকাতে থাকেন, কেবল ঝলকাতে থাকেন; আর
আপনার তত্ব, বুলেট আর বারুদ হয়ে,
ঘৃণা আর প্রেম হয়ে,
ভাঙ্গন আর নির্মাণ হয়ে বেরোতে থাকে; অবিরাম বেরোতে থাকে।

পুয়েরটরিকো থেকে ফিলিপিন্স,
ব্রাজিল থেকে বাহামাস
মার্ক্স, আপনি মহান মার্ক্স,
থাকেন এইখানে, মুহুর্তের উদ্ভাসনে।

কার্ল মার্ক্স ইজ ডেড, লং লিভ কার্ল মার্ক্স।

বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

ত্রাণ শিবিরের সনেট ~ শুভাশীষ মোদক চৌধুরী

১২ই নভেম্বর ২০০৭: ওই বছরে নিহত নন্দীগ্রাম এলাকার ২৭ জন সিপিএম কর্মীদের নাম প্রকাশ হলো। একই সাথে গত এগারো মাস ঘরছাড়া শতাধিক সিপিএম পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল অস্থায়ী ত্রান শিবিরে। সেই ঝুপড়িগুলো পুড়িয়ে দিল তৃণমূল, অতিবাম, বিজেপি চক্র। বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া আশঙ্কা ব্যক্ত করলো - পরিবার গুলি বাড়ি ফিরতে চাইলে সংঘাত বাড়বে। কবিতাটা ওই সময়েই লেখা। তারপর গত ষোলো বছরে অনেক জার্সি বদল হয়েছে, ঘর পুড়েছে, পুড়ছে। লেখাটার প্রাসঙ্গিকতা বদলায়নি বোধ হয়...



ত্রাণ শিবিরের সনেট
শুভাশীষ মোদক চৌধুরী

চেষ্টাও কোরোনা, তোমার ঘরে ফিরতে মানা।
তোমার জন্যে এই কলমে কান্না ঝরবেনা।
তোমার মরা ছেলের শরীর আঁকবেনা রং-তুলি,
তোমার গায়েও চিহ্ন আছে। বাতাসেতে শুনি
সেটার বাজার বিশেষ নেই। তুমি অপাঙক্তেয়।
আমরা তোমার বেঁচে থাকাই করেছি সন্দেহ!

তোমার ভাঙ্গা বাড়ির কথা দু-এক জনে জানে,
কিন্তু বাড়ি ফিরতে গেলে জানবে উনিশ কোটি।
এখন সুশীল সমাজ কাঁদি এগারো মাস পরে -
তোমার দিকে নজর দিলেই তৃতীয় পাতার ক্ষতি।
বদলে জামা সেই পাতাতেই জায়গাটুকু করে,
বুদ্ধিজীবীর নিয়ম মত পাল্টি খাবো পরে
সময়বুঝে। বিকিকিনি খানিক চোখের জল...
মিডিয়া চায়, আমিও চাই - জানতে তোমার দল।

বুধবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪

গান্ধীজি ও কুষ্ঠ রোগ ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

সেবাগ্রামে থাকার সময় গান্ধীজি সময় পেলেই লম্বা হাঁটা লাগাতেন। ১৯৩৯ এর ডিসেম্বর আশ্রম থেকে বেড়িয়ে গান্ধীজি দেখলেন  হাতে পুঁটুলি নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলেন। গান্ধীজি চিনতে পারলেন, শাস্ত্রীজি। গান্ধীজির মুখে একটা চিন্তার ছায়া পড়লো। শাস্ত্রীজি সেটা লক্ষ করেই বললেন, "আপনার কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলাম না। হরিদ্বারে বসে নিজের হাতে কাটা সুতো আপনার হাতে তুলে দিতে এসেছি। আমি আশ্রমের ভেতরে যাবো না, এই গাছতলায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবো  সকালে চলে যাবো"। কে এই শাস্ত্রীজি, কেনই বা তিনি আশ্রমে না ঢুকেই চলে যেতে চাইছেন এটা জানতে গেলে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে।

গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। উনি ও অন্য নেতারা গ্রেপ্তার হন, পুনের ইয়েরওয়ারা জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকার সময়, গান্ধীজি জেলসুপার ভান্ডারী সাহেবের কাছে দত্তাত্রেয় পারচুরে শাস্ত্রী নামের সহবন্দী সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। উনি ভান্ডারী কে অনুরোধ করেন খোঁজ নিতে যে কোথায় শাস্ত্রীজিকে আটকে রাখা আছে, ভান্ডারী কে বলেন " যদি উনি আমার সংগে একসাথে থাকেন তাহলে আমরা একে অন্যকে সংগ দিতে দিতে পারি, আলাপ আলোচনা করে সময় কাটাতে পারি।

ভান্ডারী তার উত্তরে বলেন, " শাস্ত্রীজির কুষ্ঠ আছে বলে তাকে জেলের অন্য সেকশনে রাখা হয়েছে।" এটা শুনে গান্ধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। শাস্ত্রীজি একজন পড়াশোনা করা শিক্ষিত, পন্ডিত মানুষ যার বেদ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। 

এরপরে গাঁধীজি শাস্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন মন খারাপ না করতে এবং অনুরোধ জানান চিঠিপত্র এর মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতে, কোনো প্রয়োজন এ সাহায্য চাইতে।

শাস্ত্রীজি তার উত্তরে লেখেন, " যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছু তুলোর ব্যবস্থা করবেন যাতে আমি আমার ক্ষত গুলি পরিস্কার রাখতে পারি; আর যদি কিছু বই এর ব্যবস্থা করা যায়।

চিঠি পাওয়ার পরে মহাদেব দেশাই যখন গাঁধীজি কে দেখতে আসেন জেলে, তখন গাঁন্ধীজির নির্দেশে দেশাই ওইসব ব্যাবস্থা করেন ও শাস্ত্রীজিকে খবর পাঠান যে "শরীর আমাদের অসুস্থ হতে পারে কিন্তু চৈতন্য আমাদের জাগিয়ে রাখবে।"

গান্ধীজীর এই চিঠি "মৃত সঞ্জীবনী এর মতো কাজ করে শাস্ত্রীজির জন্য এবং তিনি গাঁধীজির এই কথাতে বিপুলভাবে উজ্জীবিত হন।
 
কোনোও সময়ে গাঁধীজি জেলে অনশন করতেন। তাঁর জীবন যখন একটা সুতোয় ঝুলছে, সেই সময়ে সরকার সমঝোতা করেছে।  কে গাঁধীজিকে অনশন ভঙ্গ এর সময় প্রথম ফলের রস খাওয়াবে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। বাপু চেয়েছিলেন শাস্ত্রীজি এই কাজের ভার নিক। সরকার বাহাদুর মেনে নেওয়ার পরে সেটাই হয়। শাস্ত্রী এগিয়ে আসেন।। জেলার ভাণ্ডারী সাহেব এই দৃশ্য দেখে নিজের চোখের জল আটকাতে পারেন নি।

কুষ্ঠরোগীর প্রতি গান্ধীজির এই মনোভাবের শুরু কিন্ত অনেক আগে। দক্ষিণ আফ্রিকায়, নাটাল এ এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন গাঁধীজি। হটাৎ খেয়াল করলেন দূরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদল লোক খুব মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। হাত নেড়ে কাছে এসে ভিড়ের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য ডাকলেও তারা সাড়া দিল না। 

গাঁন্ধীজি ওদের দিকে এগিয়ে এলেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য। এগিয়ে আসা মাত্রই ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "গান্ধীভাই আমাদের কাছে আসবেন না।। আমরা লেপার, কুষ্ঠরুগী।" এসব শোনার পরেও গান্ধী এগিয়ে এলেন, কথা বললেন ওদের সাথে।

কয়েকজনের হাতের আঙ্গুল খসে গেছে তো কারুর পায়ের আঙ্গুল। কারুর ভুরুর লোম উঠে গেছে। ওরা কে কি চিকিৎসার সুযোগ পায়, গান্ধী জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে স্তম্ভিত, স্তব্ধ।

ওদের কথায়, " কোনো ডাক্তার আমাদের চিকিৎসা করতে চায় না; আমরাই যে যার নিজের চিকিৎসা করি নিমপাতার রস দিয়ে।" যখন জানতে চাওয়া হল যে ওই রসে কোনো উপকার হচ্ছে কি না, তখন সবারই উত্তর না, ওরা কেবল ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। 

ঠিক ওই মুহূর্তে গান্ধীজি ঠিক করলেন যে ওই মানুষগুলির জন্য ওনাকে কিছু করতেই হবে। উনি ওদের বাড়িতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন কিন্তু দিনের বেলায় কারুর সাহস হল না তার বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ার। 

গান্ধীজি যখন রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন তখন ওরা গিয়ে উপস্থিত। ওদের ডেকে নিলেন ভেতরে। ওদের ঘা পরিষ্কার করে দিলেন, কিছু খাবার দাবার বের করে খাওয়ালেন, আর ওদের জীবন কাহিনী শুনলেন, কিভাবে ওরা গ্রামের বাইরে একটা খণ্ডহরে বাসা করে থাকে আর বাঁচার চেষ্টা করে। 

ওদের জলের অভাব, নাগাল পায় না, তাই বরুনদেব যখন কৃপা করে মুখ তুলে চান তখন ওরা সেই বারিধারাতে স্নান করে। তা না হলে ওরা ওদের সেই ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় ই না কেচে দিনের পর দিন পড়ে থাকে কারণ স্নান করার বা কাপড় কাচার জল থেকে ওরা বঞ্চিত। 

গ্রামের আনন্দ-অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট দিয়েই পেট ভরাতে হয়। জীবন কাহিনী বর্ণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে লোকগুলি বিদায় নিতে চায়। গান্ধীজি বিদায়ের সময় বলেন যে তিনি ওদের জন্য কিছু করতে চান। করেওছিলেন,  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, ওষুধপত্র এর ব্যবস্থা।

সেবাগ্রামের সেই দিনটাতে ফেরত যাই আমরা। 
এই সেই শাস্ত্রীজি। গাঁধীজি  দক্ষিণ ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক ভেলাধুন কে নির্দেশ দেন শাস্ত্রীজির জন্য একটি নতুন ধুতি ও বেনিয়ান আনতে।

পরের দিন যথানিয়মে প্রার্থনা সভায় মিলিত হলেন সব আশ্রমিকরা। যেখানে গাঁধীজি ঘোষণা করেন, "আজ আমাদের মধ্যে বেদ ও অন্যান্য বিষয়ে পারঙ্গম একজন পন্ডিত মানুষ শাস্ত্রীজি আমাদের মধ্যে উপস্থিত। উনি কুষ্ঠ রোগ এ ভুগছেন। আপনারা কি ওনাকে সমর্থন করবেন  ও ওনাকে এই আশ্রমে থাকতে দেবেন ? " 

চারদিকে তখন সূচ পতনের নীরবতা। আশ্রমিকদের অনুৎসাহিত মনোবাসনা বুঝে গাঁধীজি আবেদন রাখলেন, " যদি আপনাদের বিবেক অনুমোদন দেয় তাহলেই আপনারা সম্মতি দেবেন।"

গান্ধীজীর কথায় সেদিন কাজ হয়েছিল। মানুষ তার কথায় ভরসা রেখেছিল। শাস্ত্রীজি আশ্রমেই থেকে যান। আশ্রমের পূর্বদিকে তার জন্য একটি কুটির তৈরি হয়। গান্ধীজি প্রতিদিন সময় পেলে নিজের হাতে তার সেবা করতেন, ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতেন, জামাকাপড় পড়িয়ে দিতেন।  তার সাথে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করতেন। ডাঃ জীবরাজ মেহেতা এর দেওয়া ওষুধ সেবনের পরে শাস্ত্রীজির উন্নতি দেখে গাঁধীজি খুবই সন্তুষ্ট হন। কাছেই দত্তপুরে ওয়ার্ধায় মনোহর দেওয়ান কুষ্ঠ পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলেন। শাস্ত্রীজি সেখানে স্থানান্তরিত হ'ন ও আমৃত্যু সেখানেই থেকে যান। গান্ধীজি এই মনোহর দেওয়ান কে "প্রকৃত মহাত্মা" খেতাবে সম্ভাষিত করেন। 

কুষ্ঠরোগ নিয়ে গান্ধীজির এই অবদানের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। এক। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন লোক দেখানো ঘটনা নয়। এর ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম দেওয়া হল। দুই। গান্ধীজির এর সেবার মনোভাবের সাথে আগাগোড়া বিজ্ঞান জড়িয়ে ছিল। দেশ বিদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী যারা কুষ্ঠরোগ নির্মূল করার অভিযানে জড়িত তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ওয়ার্ধা সেবাগ্রামে এসেছেন গান্ধীজির সাথে আলাপ আলোচনা পরামর্শ করেছেন। উনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে কিভাবে এই রোগ দূর করা যায় তাতে উৎসাহী ছিলেন। 

আজ ৩০শে জানুয়ারি। শহীদ দিবস। সারা ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে কুষ্ঠ-বিরোধী দিবস গান্ধীজীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। একজন সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গাঁধীজিকে আজকের দিনে খ্যাপা কুকুরের মতো রাগের জ্জ্বালায় গুলি করে খুন করে। সেই সাইকোপ্যাথ মানসিক রুগীকে আজ ততোধিক মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত কিছু মানুষ হিরো বানাতে চাইছে। কুষ্ঠরুগীদের মানুষ হিসেবে বাঁচার লড়াইতে কুষ্ঠ রোগের নির্মূল অভিযানে জড়িত একজন সামান্য স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আজ বাপুকে এই স্মরণ। উনি বড় মাপের মনের অধিকারী ছিলেন। আশা রাখি বিপরীত মেরুর মতাদর্শের রাজনীতির একজন ভারতবাসীর কাছ থেকেও উনি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করবেন, ফিরিয়ে দেবেন না। ঘেন্না ও বিদ্বেষ এর সব রকম চাষ আবাদ বন্ধ হয়ে আমার দেশ হয়ে উঠুক "সকল দেশের সেরা"

জাতীয় কুষ্ঠ-বিরোধী দিবসে শপথ: ঘেন্না মুক্ত ভারত, কুষ্ঠ মুক্ত ভারত। আসুন মানুষে মানুষে হাত বাড়াই।

সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম:
১৮৯৪-৯৫: ডারবান: রাস্তায় গান্ধীজির সাথে কুষ্ঠরোগীর সাক্ষাৎ।
১৮৯৭: ডারবান: নিজের বাড়িতে গান্ধীজি কুষ্ঠরোগীর পরিচর্যা করলেন।
১৯০৫: দক্ষিণ আফ্রিকা: ভারতে কাজ করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন একজন মিশনারিকে নিয়ে গান্ধীজি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন।
১৯১৩-১৪: পুনে: সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে উদ্ধার করলেন।
১৯১৩-১৫: মাদ্রাজ: একজন কুষ্ঠরোগী যিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তার ক্ষতস্থান গান্ধীজি নিজের কাপড় দিয়ে মুছে দিলেন।
১৯১৭: চম্পারণ: বিখ্যাত চম্পারণ যাত্রার সময় গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে সঙ্গে করে  পৌঁছে দিলেন গন্তব্যে।
১৯২৫: কটক: ১৯শে আগস্ট, গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৫: পুরুলিয়া: ১২ই সেপ্টেম্বর গান্ধীজি পুরুলিয়া কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৭: কটক: ২১শে ডিসেম্বর গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার আগে কয়েকজনের সাথে মেলালেন হাত।
১৯২৯: আলমোড়া: কাঁসাই, বাগেশ্বর এর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম: কস্তুরবা ট্রাস্ট গঠিত হ'ল। কুষ্ঠরোগ নিয়ে কর্মসূচি ওই ট্রাস্টের অন্যতম লক্ষ্য।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম:  গান্ধীজি দত্তপুর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন ও তার কর্ণধার মনোহর দেওয়ানকে "প্রকৃত মহাত্মা" বলে আখ্যা দিলেন।
১৯৪৫: সেবাগ্রাম: ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বিখ্যাত কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ডঃ ককরেন এসে দেখা করলেন গান্ধীজির সাথে।
১৯৪৬: মাদ্রাজ: ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চেনগেলপুট উইলিংডন কুষ্ঠ হাসপাতালে রুগীদের সাথে দেখা করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৭: ১২ই জানুয়ারি গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় কলম ধরলেন সিন্ধ প্রদেশের কুষ্ঠরোগীদের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাকরণ নিয়ে উত্থাপিত বিল কে ধিক্কার জানিয়ে।
১৯৪৭: নোয়াখালী:  ৫ই ফেব্রুয়ারি তার প্রার্থনা শেষে সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব এর কথা উল্লেখ করলেন।
১৯৪৭: কলকাতা: ৪ঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীজি দেখতে গেলেন গোবরা মানসিক হাসপাতাল, বললেন যে এদের দুর্দশা কুষ্ঠরোগীদের চেয়েও খারাপ।
১৯৪৭: দিল্লি: ২৩শে ও ২৪শে অকটবর পরপর দু'দিন প্রার্থনা শেষের সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগের উল্লেখ করলেন। বার্তা পাঠালেন সারা ভারত কুষ্ঠরোগ কর্মী সম্মেলনে।

শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৪

বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের ১১৫তম এবং ১১৬তম সর্গ ~ নবারুণ ঘোষাল

বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের ১১৫তম এবং ১১৬তম সর্গ দুটিতে লঙ্কার অশোকবনে রামের সাথে সীতার দেখা হওয়ার পর তাঁদের কথোপকথন বাংলায় অনুবাদ করলাম। 🙏🙏

বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধ কান্ড ১১৫ সর্গ

প্রথম শ্লোকঃ
तां तु पार्श्वे स्थितां प्रह्वां रामः संप्रेक्ष्ये मैथिलीम् |
हृदयान्तर्गतं भावं व्याहर्तुमुपचक्रमे ||
অতঃপর অবনতা মৈথিলীকে পার্শ্বে দেখিয়া রাম হৃদয়ের অন্তর্গত ভাব ব্যক্ত করিলেন।

দ্বিতীয় শ্লোকঃ
एषासि निर्जिता भद्रे शत्रुं जित्वा रणाजिरे |
पौरुषाद्यदनुष्ठेयं मयैतदुपपादितम् ||
হে ভদ্রে, শত্রুকে রণক্ষেত্রে পরাজিত করিয়া তোমাকে আমি জয় করিয়াছি। পৌরুষের দ্বারা যাহা করণীয়, তাহা আমি সম্পন্ন করিয়াছি।

তৃতীয় শ্লোকঃ
गतोऽस्म्यन्तममर्षस्य धर्षणा संप्रमार्जिता |
अवमानश्च शत्रश्च युगपन्निहतौ मया ||
আমার লজ্জাজনক অবস্থা এবং আমার প্রতি অন্যায়ের অবসান হইয়াছে। আমার অবমাননাকারী এবং আমার শত্রু যুগপৎ আমার দ্বারা নিহত হইয়াছে।

চতুর্থ শ্লোকঃ
अद्य मे पौरुषं दृष्टमद्य मे सफलः श्रमः |
अद्य तीर्णप्रतिज्ञोऽहं प्रभवाम्यद्य चात्मनः॥
অদ্য আমার পৌরুষ প্রদর্শিত হইয়াছে, অদ্য আমার শ্রম সফল হইয়াছে। অদ্য আমি প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়াছি, অদ্য আমি নিজেই নিজের প্রভু।

পঞ্চম শ্লোকঃ
या त्वं विरहिता नीता चलचित्तेन रक्षसा |
दैवसंपादितो दोषो मानुषेण मया जितः ||
যে তুমি এক চপলমতি রাক্ষসের দ্বারা অপহৃতা হইয়াছিলে, আমি এই মনুষ্য, দৈবদোষের অপসারণ করিয়া তাহাকে জয়লাভ করিয়াছি।

ষষ্ঠ শ্লোকঃ
संप्राप्तमवमानं यस्तेजसा न प्रमार्जति |
कस्तस्य पौरुषेणार्थो महताप्यल्पचेतसः ||
যিনি নিজের তেজের দ্বারা নিজ অবমাননা দূর করিতে না পারেন, সেই অতি অল্পচেতন পুরুষের পৌরুষের কি অর্থ?

সপ্তম শ্লোকঃ
लङ्घुनं समुद्रस्य लङ्कायाश्चापि मर्दनम् |
सफलं तस्य च श्लाघ्यमद्य कर्म हनूमतः॥
যিনি সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কা ধ্বংস করিয়াছিলেন, সেই হনুমানের প্রশংসনীয় কর্ম অদ্য সফল হইয়াছে।

অষ্টম শ্লোকঃ
युद्धे विक्रमतश्चैव हितं मन्त्रयतस्तथा |
सुग्रीवस्य ससैन्यस्य सफलोऽद्य परिश्रमः ||
যিনি যুদ্ধে বিক্রম দেখাইয়াছেন এবং  হিতকারী মন্ত্রণা দিয়াছেন, সেই সুগ্রীব এবং তাঁহার সেনাদিগের পরিশ্রম অদ্য সফল হইয়াছে।

নবম শ্লোকঃ
विभीषणस्य च तथा सफलोऽद्य परिश्रमः |
विगुणं भ्रातरं त्वक्त्वा यो मां स्वयमुपस्थितः ||
যে বিভীষণ তাঁহার গুণহীন ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিয়া স্বয়ং আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছেন, তাঁহার পরিশ্রম অদ্য সফল হইয়াছে।

দশম শ্লোকঃ
इत्येवं वदतः श्रुत्वा सीता रामस्य तद्वचः |
मृगीवोत्फुल्लनयना बभूवाश्रुपरिप्लुता ||
রামের মুখে এইরূপ বচন শুনিয়া মৃগীর ন্যায় উৎফুল্লনয়না সীতা অশ্রুপরিপ্লুতা হইলেন।

একাদশ শ্লোকঃ
पश्यतस्तां तु रामस्य समीपे हृदयप्रियाम् |
जनवादभयाद्राज्ञो बभूव हृदयं द्विधा ||
নিজ সমীপে হৃদয়প্রিয়াকে দেখিয়া জন অপবাদের ভয়ে রামের হৃদয় দ্বিধাগ্রস্ত হইল।

দ্বাদশ শ্লোকঃ
सीतामुत्पलपत्राक्षीं नीलकुञ्चितमूर्धजाम् |
अवदद्वै वरारोहां मध्ये वानररक्षसाम् ||
বানর এবং রাক্ষসদিগের মধ্যে উৎপলাক্ষী, নীলকুঞ্চিতকেশী,  সুনিতম্বিনী সীতাকে দেখিয়া (রাম) এইরূপ বলিলেন

ত্রয়োদশ শ্লোকঃ
यत्कर्तव्यं मनुष्येण धर्षणां प्रतिमार्जता |
तत्कृतं रावणं हत्वा मयेदं मानकाङ्क्क्षिणा ||
নিজ অপমানের প্রতিকার করিবার জন্য মনুষ্যের যাহা কর্তব্য, সম্মানার্থে রাবণকে হত্যা করিয়া আমি তাহা করিয়াছি।

চতুর্দশ শ্লোকঃ
निर्जिता जीवलोकस्य तपसा भावितात्मना |
अगस्त्येन दुराधर्षा मुनिना दक्षिणेव दिक् ||
যে দক্ষিণ দিক বিশুদ্ধহৃদয় তপস্বী অগস্ত্যের পক্ষেও দুরতিক্রম্য ছিল, সেই জীবলোককেও (দেশকেও) আমি জয় করিয়াছি।
পঞ্চদশ শ্লোকঃ 
विदितश्चास्तु भद्रं ते योऽयं रणपरिश्रमः |
सुतीर्णः सुहृदां वीर्यान्न त्वदर्थं मया कृतः ||
হে ভদ্রে, তোমার জানা উচিত যে এই রণকার্য যাহাতে আমি আমার সুহৃদদিগের বীরত্বের সাহায্যে উত্তীর্ণ হইয়াছি, তাহা তোমার নিমিত্ত করি নাই।

ষোড়শ শ্লোকঃ
रक्षता तु मया वृत्तमपवादम् च सर्वतः |
प्रख्यातस्यात्मवंशस्य न्यङ्गं च परिमार्जता ||
(আমি ইহা করিয়াছি) সর্বত্রব্যাপী অপবাদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এবং আমার প্রখ্যাত বংশের হীনাবস্থার পরিমার্জনের জন্য।

সপ্তদশ শ্লোকঃ
प्राप्तचारित्रसंदेह मम प्रतिमुखे स्थिता |
दीपो नेत्रातुरस्येव प्रतिकूलासि मे दृढम् ||
চরিত্রসন্দেহ প্রাপ্ত হইয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত তুমি নেত্ররোগীর সম্মুখে দীপের ন্যায় অত্যন্ত অবাঞ্ছিত হইয়া আছ।

অষ্টাদশ শ্লোকঃ
तद्गच्छ त्वानुजानेऽद्य यथेष्टं जनकात्मजे |
एता दश दिशो भद्रे कार्यमस्ति न मे त्वया ||
সেইহেতু হে জনকাত্মজা, অদ্য আমি তোমাকে এই দশ দিকের মধ্যে যে কোনও দিকে যথেচ্ছ যাইবার অনুমতি দিতেছি, তোমাকে দিয়া আমার আর কোনো কাজ নাই।

উনবিংশতি শ্লোকঃ
कः पुमांस्तु कुले जातह् स्त्रियं परगृहोषिताम् |
तेजस्वी पुनरादद्यात् सुहृल्लेख्येन चेतसा ||
কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ পরগৃহে আশ্রিতা স্ত্রীকে প্রফুল্লচিত্তে পুনরায় গ্রহণ করিবে?

বিংশতি শ্লোকঃ
रावणाङ्कपरिक्लिष्टां दृष्टां दुष्टेन चक्षुषा |
कथं त्वां पुनरादद्यां कुलं व्यपदिशन् महत् || 
তুমি রাবণের অঙ্কে ক্লিষ্ট হইয়া, তাহার দুষ্ট চক্ষুর দ্বারা দৃষ্ট হইয়া কিরূপে আমার মহৎ কুলে পুনরায় গৃহীত হইবে তাহা বল। 

একবিংশতি শ্লোকঃ 
तदर्थं निर्जिता मे त्वं यशः प्रत्याहृतं मया |
नास्थ् मे त्वय्यभिष्वङ्गो यथेष्टं गम्यतामितः || 
তোমাকে আমি জয় করিয়াছি আমার হৃত যশের পুনরুদ্ধারের জন্য। তোমার সম্পর্কে আমার আর কোনো গভীর অনুভূতি নাই, তুমি যথা ইচ্ছা গমন করিতে পার। 

দ্বাবিংশতি শ্লোকঃ 
तदद्य व्याहृतं भद्रे मयैतत् कृतबुद्धिना |
लक्ष्मणे वाथ भरते कुरु बुद्धिं यथासुखम् || 
হে ভদ্রে, সেই হেতু  অদ্য আমি কৃতবুদ্ধি হইয়া তোমায় বলিতেছি, তুমি যথাসুখে লক্ষ্মণ কিম্বা ভরতের প্রতি মনঃসংযোগ করিতে পার। 

ত্রয়োবিংশতি শ্লোকঃ 
शत्रुघ्ने वाथ सुग्रीवे राक्षसे वा विभीषणे |
निवेशय मनः सीते यथा वा सुखमात्मनः || 
শত্রুঘ্ন অথবা সুগ্রীব অথবা রাক্ষস বিভীষণ যাহার কাছে সুখী হইবে, হে সীতা তুমি তাহাতে মনোনিবেশ কর। 

চতুর্বিংশতি শ্লোকঃ 
न हि त्वां रावणो दृष्ट्वो दिव्यरूपां मनोरमाम् |
मर्षयेत चिरं सीते स्वगृहे पर्यवस्थिताम् || 
হে সীতা, তোমার ন্যায় দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে স্বগৃহে অবস্থিত দেখিয়া রাবণ দীর্ঘকাল নিজেকে সংযত রাখিতে পারে না। 

পঞ্চবিংশতি শ্লোকঃ 
ततः प्रियार्हश्रवणा तदप्रियं प्रियादुपश्रुत्य चिरस्य मैथिली |
मुमोच बाष्पं सुभृशं प्रवेपिता गजेन्द्रहस्ताभिहतेव वल्लरी ||
ততঃপর চিরকাল প্রিয়বাক্য শ্রবণে অভ্যস্ত মৈথিলী প্রিয়মুখে এইরূপ অপ্রিয় বাক্য শুনিয়া হস্তীর দ্বারা আক্রান্ত লতার ন্যায় দীর্ঘক্ষণ কম্পমান হইয়া প্রভূত অশ্রু মোচন করিতে লাগিলেন।

ইতি ঋষি বাল্মিকী বিরচিত আদিকাব্য রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের পঞ্চদশোত্তর শততম সর্গ। 

বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধ কান্ড ১১৬ সর্গ 

প্রথম শ্লোকঃ 
एवम् श्रुत्वा तु वैदेही परुषं लोमहर्षणम् |
राघवेण सरोषेण भृशं प्रव्यथिताभवत् || 
রাঘবের এরূপ রোষপূর্ণ কঠোর লোমহর্ষক কথা শুনিয়া বৈদেহী অত্যন্ত ব্যথিত হইলেন। 

দ্বিতীয় শ্লোকঃ
सा तदश्रुतपूर्वं हि जने महति मैथिली |
श्रुत्वा भर्तृवचो रूक्षं लज्जया व्रीडिताभवत् || 
এতজনের সম্মুখে পতির এসকল অশ্রুতপূর্ব কথা শুনিয়া মৈথিলী লজ্জায় ব্রীড়াবনতা হইলেন। 

তৃতীয় শ্লোকঃ 
प्रविशन्तीव गात्राणि स्वान्येव जनकात्मजा |
वाक्षल्यैस्तैः सशल्येव भृशमश्रूण्यवर्तयत् ||
স্বীয় গাত্রে এইসকল সুতীক্ষ্ণ বাক্যবাণগুলির প্রবেশ অনুভব করিয়া জনকদুহিতা অজস্র অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিলেন। 

চতুর্থ শ্লোকঃ 
ततो बाष्पपरिक्लिष्टं प्रमार्जन्ती स्वमाननम् |
शनैर्गद्गदया वाचा भर्तारमिदमब्रवीत् ||
ততঃপর নিজ বাষ্পপূর্ণ আনন পরিমার্জন করিয়া ধীরে ধীরে গদগদ বাক্যে পতিকে বলিলেন। 

পঞ্চম শ্লোকঃ 
किं मामसदृशं वाक्यमीदृशं श्रोत्रदारुणम् |
रूक्षं श्रावयसे वीर प्राकृतः प्राकृताम् इव ||
হে বীর, কিহেতু আমার ন্যায় নারীকে এইরূপ দারুণ রুক্ষ বাক্য শুনাইতেছেন, যেরূপ কোনও সাধারণ পুরুষ কোনো সাধারণ নারীকে শুনাইয়া থাকে? 

ষষ্ঠ শ্লোকঃ 
न तथास्मि महाबाहो यथा त्वमवगच्छसि |
प्रत्ययं गच्छ मे स्वेन चारित्रेणैव ते शपे ||
হে মহাবাহু, আপনি যেরূপ ভাবিতেছেন, আমি সেইরূপ নহি। আমি নিজের চরিত্রের দিব্য দিয়া বলিতেছি, আমার কথা বিশ্বাস করুন। 

সপ্তম শ্লোকঃ 
पृथक्स्त्रीणां प्रचारेण जातिं त्वं परिशङ्कसे |
परित्यजेमां शङ्कां तु यदि तेऽहं परीक्षिता || 
আপনি আশঙ্কাবশতঃ আমাকে পতিতা স্ত্রীজাতিসদৃশ বলিয়া প্রচার করিতেছেন। যদি আমি আপনার দ্বারা পরীক্ষিতা হইয়া থাকি, তবে এই আশঙ্কা ত্যাগ করুন। 

অষ্টম শ্লোকঃ 
यद्यहं गात्रसंस्पर्शं गतास्मि विवशा प्रभो |
कामकारो न मे तत्र दैवं तत्रापराध्यति || 
হে প্রভু, যদি আমি গাত্রসংস্পর্শে যাইবার জন্য বাধ্য হইয়া থাকি, তবে তাহাতে আমার কোনও ভূমিকা নাই, তাহা দৈবের বশে হইয়াছে। 

নবম শ্লোকঃ 
मदधीनं तु यत्तन्मे हृदयं त्वयि वर्तते |
पराधीनेषु गात्रेषु किं करिष्याम्यनीश्वरा ||
আমার অধীন যে হৃদয়, তাহা আপনাতেই স্থির ছিল। পরাধীন এই গাত্রের আমি অসহায় অবস্থায় কি করিতে পারিতাম? 

দশম শ্লোকঃ 
सहसंवृद्धभावाच्च संसर्गेण च मानद |
यद्यहं ते न विज्ञाता हता तेनास्मि शाश्वतम् || 
হে মানদ, একসঙ্গে বৃদ্ধিলাভ করিয়া এবং এক সংসর্গে থাকিয়াও যদি আমি আপনার কাছে অজ্ঞাত হইয়া থাকি, তবে আমি চিরকালের জন্য হতসর্বস্ব হইলাম। 

একাদশ শ্লোকঃ 
प्रेषितस्ते यदा वीरो हनूमानवलोककः |
लङ्कास्थाहं त्वया वीर किं तदा न विसर्जिता || 
হে বীর, আমি লঙ্কায় থাকাকালীন যখন আপনি বীর হনুমানকে অবলোকন করিবার জন্য প্রেরণ করেন, সেই সময়েই কেন আমাকে বিসর্জন দিলেন না? 

দ্বাদশ শ্লোকঃ 
प्रत्यक्षं वानरेन्द्रस्य त्वद्वाक्यसमनन्तरम् |
त्वया सन्त्यक्तया वीर त्यक्तं स्याज्जीवितं मया ||
হে বীর, বানরশ্রেষ্ঠের মুখে আপনার দ্বারা ত্যক্ত হইবার সংবাদ শুনিবামাত্র আমি তাঁহার সম্মুখে জীবন ত্যাগ করিতাম। 

ত্রয়োদশ শ্লোকঃ 
न वृथा ते श्रमोऽयं स्यात्संशये न्यस्य जीवितम् |
सुहृज्जनपरिक्लेशो न चायं निष्फलस्तव || 
তাহা হইলে আপনার এই বৃথা শ্রমব্যয় হইত না, আপনার জীবনও বিপন্ন হইত না, আপনার সুহৃদজনেরও এই নিষ্ফল ক্লেশভোগ হইত না। 

চতুর্দশ শ্লোকঃ 
त्वया तु नरशार्दूल क्रोधमेवानुवर्तता |
लघुनेव मनुष्येण स्त्रीत्वमेव पुरस्कृतम् || 
হে নরশার্দুল, আপনি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া আমার সহিত লঘু মনুষ্যের স্ত্রীর ন্যায় আচরণ করিলেন। 

পঞ্চদশ শ্লোকঃ 
अपदेशेन जनकान्नोत्पत्तिर्वसुधातलात् |
मम वृत्तं च वृत्तज्ञ बहु ते न पुरस्कृतम् ||
জনকের দ্বারা আমার জন্ম এক ছল, আমি বাস্তবে বসুধার সন্তান। আমার এই বৃত্তান্ত জানিয়াও হে বৃত্তজ্ঞ আপনি তাহার মর্যাদা দিলেন না। 

ষোড়শ শ্লোকঃ 
न प्रमाणीकृतः पाणिर्बाल्ये बालेन पीडितः |
मम भक्तिश्च शीलं च सर्वं ते पृष्ठतः कृतम् || 
আমার বাল্যকালে আপনি আপনার বাল্যাবস্থায় আমার পাণিপীড়ন (বিবাহ) করিয়াছিলেন, তাহার অমর্যাদা করিলেন, আমার ভক্তি, শীলতা সকলই আপনি অগ্রাহ্য করিলেন। 

সপ্তদশ শ্লোকঃ 
इति ब्रुवन्ती रुदती बाष्पगद्गदभाषिणी |
उवाच लक्ष्मणं सीता दीनं ध्यानपरायणम् ||
বাষ্পাকুল গদগদ কন্ঠে এত বলিয়া ক্রন্দনরতা সীতা দুঃখিত, চিন্তান্বিত লক্ষ্মণকে বলিলেন। 

অষ্টাদশ শ্লোকঃ 
चितां मे कुरु सौमित्रे व्यसनस्यास्य भेषजम् |
मिथ्यापवादोपहता नाहं जीवितुमुत्सहे || 
হে সৌমিত্র, আমার জন্য চিতা প্রস্তুত কর, যাহা আমার এই দুর্দশার ঔষধ। মিথ্যা অপবাদের ভাগিনী হইয়া আমি আর জীবিত থাকিতে ইচ্ছা করি না। 

উনবিংশতি শ্লোকঃ 
अप्रीतेन गुणैर्भर्त्रा त्यक्ता या जनसंसदि |
या क्षमा मे गतिर्गन्तुं प्रवेक्ष्ये हव्यवाहनम् ||
পতি যখন আমার চরিত্র সম্পর্কে অসন্তুষ্ট হইয়া জনসমক্ষে আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তখন অগ্নিতে প্রবেশ করাই আমার একমাত্র গতি। 

বিংশতি শ্লোকঃ 
एवं ब्रुवाणा रुदती बाष्पगद्गदभाषिणी |
अब्रवील्लक्ष्मणं सीता दीनं ध्यानपरं स्थितम् || 
ক্রন্দনরতা সীতা বাষ্পাকুল গদগদ কন্ঠে গভীর চিন্তামগ্ন দুঃখিত লক্ষ্মণকে এই সকল বলিলেন। 

একবিংশতি শ্লোকঃ 
स विज्ञाय मनश्छन्दं रामस्याकारसूचितम् |
चितां चकार सौमित्रिर्मते रामस्य वीर्यवान् || 
রামের ইঙ্গিতে রামের মনোভাব জানিয়া বীর সৌমিত্র রামের মতানুসারে চিতা সাজাইলেন। 

দ্বাবিংশতি শ্লোকঃ 
न हि रामं तदा कश्चित्कालान्तकयमोपमम् |
अनुनेतुमथो वक्तुं द्रष्टुं वा प्यशकत्सुहृत् || 
সেই সময়ে রামের কালান্তক যমের ন্যায় মূর্তি দেখিয়া সুহৃদবর্গের কেহই তাঁহাকে কিছু বলিতে অথবা তাঁহার প্রতি  দৃষ্টিপাত করিতে সাহস করিল না। 

ত্রয়োবিংশতি শ্লোকঃ 
अधोमुखं ततो रामं शनैः कृत्वा प्रदक्षिणम् |
उपासर्पत वैदेही दीप्यमानं हुताशनम् || 
অতঃপর ধীরে ধীরে অধোমুখ রামকে প্রদক্ষিণ করিয়া বৈদেহী প্রজ্জ্বলিত হুতাশনের প্রতি অগ্রসর হইলেন। 

চতুর্বিংশতি শ্লোকঃ 
प्रणम्य देवताभ्यश्च ब्राह्मणेभ्यश्च मैथिली |
बद्धाञ्जलिपुटा चेदमुवाचाग्निसमीपतः || 
দেবতাগণ এবং ব্রাহ্মণগণকে প্রণাম করিয়া মৈথিলী কৃতাঞ্জলিপুটে অগ্নির সমীপে গিয়া এইরূপ কহিলেন। 

পঞ্চবিংশতি শ্লোকঃ 
यथा मे हृदयं नित्यं नापसर्पति राघवात् |
तथा लोकस्य साक्षी मां सर्वतः पातु पावकः ||
যেহেতু আমার হৃদয় কখনো রাঘব হইতে অপসৃত হয় নাই, অতএব জগৎকে সাক্ষী মানিয়া অগ্নিদেব আমাকে সকল দিক হইতে পরিত্রাণ করুন। 

ষড়বিংশতি শ্লোকঃ 
यथा मां शुद्धचरितां दुष्टां जानाति राघवः |
तथा लोकस्य साक्षी मां सर्वतः पातु पावकः ||
যেহেতু আমি শুদ্ধচরিত হওয়া সত্ত্বেও রাঘব আমাকে দুষ্টা বলিয়া জানিয়াছেন, অতএব জগৎকে সাক্ষী মানিয়া অগ্নিদেব আমাকে সকল দিক হইতে পরিত্রাণ করুন।

সপ্তবিংশতি শ্লোকঃ 
कर्मणा मनसा वाचा यथा नातिचराम्यहम् |
राघवं सर्वधर्मज्ञं तथा मां पातु पावकः || 
যেহেতু আমি কর্মে, চিন্তায়, বাক্যে কখনো ধর্মজ্ঞ রাঘবের বিরুদ্ধাচরণ করি নাই, অতএব অগ্নিদেব আমাকে সকল দিক হইতে পরিত্রাণ করুন।

অষ্টবিংশতি শ্লোকঃ 
आदित्यो भगवान् वायुः दिशश्चन्द्रस्तथैव च ।
अहश्चापि तथा सन्ध्ये रात्रिश्च पृथिवी तथा ।
यथान्येऽपि विजानन्ति तथा चारित्रसंयुताम् ॥
যেহেতু ভগবান সূর্য, বায়ু, চন্দ্র, দিবা, সন্ধ্যা, রাত্রি, পৃথিবী সকলেই আমাকে সচ্চরিত্রা বলিয়া জানেন। 

উনত্রিংশতি শ্লোকঃ 
एवमुक्त्वा तु वैदेही परिक्रम्य हुताशनम् ।
विवेश ज्वलनं दीप्तम् निःशङ्केनान्तरात्मना ॥
এই বলিয়া বৈদেহী হুতাশনকে পরিক্রমা করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে একাত্ম মনে জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। 

ত্রিংশতি শ্লোকঃ 
जनः स सुमहांस्तत्र बालवृद्धसमाकुलः ।
ददर्श मैथिलीं दीप्ताम् प्रविशन्तीं हुताशनम् ॥
তথায় উপস্থিত বিপুল সংখ্যক আবালবৃদ্ধজন মৈথিলীকে জ্বলন্ত হুতাশনের মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিল।

একত্রিংশতি শ্লোকঃ 
सा तप्तनवहेमाभा तप्तकाञ्चनभूषणा ।
पपात ज्वलनं दीप्तम् सर्वलोकस्य सन्निधौ ।
তপ্ত নবহেমবর্ণা তিনি তপ্তকাঞ্চন ভূষণে সজ্জিতা হইয়া সর্বজনের সম্মুখে জ্বলন্ত অগ্নিতে পতিত হইলেন। 

দ্বাত্রিংশতি শ্লোকঃ 
ददृशुस्तां विशालाक्षीम् पतन्तीं हव्यवाहनम् ।
सीतां सर्वाणि रूपाणि रुक्मवेदिनिभां तदा ॥
সর্বরূপা বিশালাক্ষী সীতাকে সকলে স্বর্ণবেদীর ন্যায় জ্বলন্ত অগ্নিতে পতিত হইতে দেখিল। 

ত্রয়োত্রিংশতি শ্লোকঃ 
ददृशुस्तां महाभागाम् प्रविशन्तीं हुताशनम् ।
सीतां कृत्स्नास्त्रयो लोकाः पुण्यामाज्याहुतीमिव ॥
ত্রিলোক দেখিল, মহাপুণ্যবতী সীতা পুণ্য ঘৃতাহুতির ন্যায় হুতাশনে প্রবেশ করিলেন। 

চতুর্তিংশতি শ্লোকঃ 
प्रचुक्रुशुः स्त्रियः सर्वान् तां दृष्ट्वा हव्यवाहने ।
पतन्तीं संस्कृतां मन्त्रः वसोर्धारामिवाध्वरे ॥
তাঁহাকে মন্ত্রপূত পবিত্র ঘৃতের ন্যায় অগ্নিতে পতিত হইতে দেখিয়া উপস্থিত সকল স্ত্রীগণ চীৎকার করিয়া উঠিল। 

পঞ্চত্রিংশতি শ্লোকঃ 
ददृशुस्तां त्रयो लोका देवगन्धर्वदानवाः ।
शप्तां पतन्तीं निरये त्रिदिवाद्देवतामिव ॥
তিন লোকের দেব, গন্ধর্ব, দানব সকলেই দেখিল, তিনি যেন অভিশপ্তা দেবীর ন্যায় স্বর্গ হইতে নরকের অগ্নিতে পতিত হইলেন। 

ষড়ত্রিংশতি শ্লোকঃ 
तस्यामग्निं विशन्त्यां तु हाहेति विपुलस्वनः ।
रक्षसां वानराणां च सम्बभूवाद्भुतोपमः ॥
তাঁহাকে অগ্নির গভীরে প্রবেশ করিতে দেখিয়া বানর এবং রাক্ষস সকলেই বিপুল হাহাকার করিয়া উঠিলে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হইল। 

ইতি ঋষি বাল্মিকী বিরচিত আদিকাব্য রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের ষোড়শোত্তর শততম সর্গ।